ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিবাহিত। ভারতের রঙ্গমঞ্চে আরেকটা স্বাধীনতা দিবস আসছে। দিল্লির লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আরো একটি ভাষণ দেবেন।
এই স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ভারতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়ে গেল।
এই নির্বাচনে দলিত সমাজের একজন মহিলা প্রতিনিধিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে গ্রহণ করা খুব একটা সাধারণ ঘটনা নয়। পৃথিবীর সর্বত্রই রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার একটি পটভূমি থাকে, একটি স্থান-কাল-পাত্রের প্রেক্ষিত থাকে। এই ঘটনা প্রমাণ দিচ্ছে যে ভারতের রাজনীতি ও সমাজতত্ত্ব দ্রুত বদলাচ্ছে। দলিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আবারও এমন ঘটনা এ দেশে ঘটছে। তার থেকে বোঝা যায় ৭৫ বছর বয়স হয়ে গেলেও ভারতীয় গণতন্ত্রের এখনো অনেক পথচলা বাকি।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে শাসকদলের স্বার্থে কাজ করছে। তাই যখন পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি অঙ্গরাজ্যে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বাড়ি থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা উদ্ধার হয় এবং সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সেই গোলাপি টাকাগুলো আমরা দেখতে পাই আর পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর বান্ধবীদের কত অট্টালিকা, কত রকমের গাড়ি, গয়নাসহ বিপুল সম্পত্তির পরিমাণ জানা যায় তখন মনে হয়, আমরা কি ৭৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ গণতন্ত্রের দেশে বসবাস করছি, নাকি অতীতের সেই পরাধীন দেশে বসবাস করছি।
স্বাধীনতা দিবস যখন আসছে তখন এই পরিস্থিতিতে আমাদের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের ভাবতে হবে যে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। অতীতের দিকে তাকিয়ে ইতিহাসের পটে সাম্প্রতিককে দেখা এবং তার সাহায্যে ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করা, এটাই তো সুস্থ নাগরিকত্বের সবচেয়ে বড় পরিচয়। দুর্নীতি বিষয়টি শুধু ভারত কেন, এই উপমহাদেশেই কোনো নতুন বিষয় নয়। আজ থেকে বহু বছর আগে বৈদিক যুগেও দুর্নীতি ছিল। একটা বই পড়েছিলাম। সেই বইটির নাম ‘Corruption in Veda’। ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে তো তস্করবৃত্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে। সমাজ যদি একটা পিরামিড হয়, তাহলে ওপরে শাসক এলিট থেকে নিচের আমজনতা পর্যন্ত দুর্নীতি প্রবাহিত। তাই বলে দীর্ঘদিন ধরে এ সমাজে দুর্নীতি আছে বলেই তো দুর্নীতিকে সমর্থন করার কথা নয়।
দুর্নীতিবিরোধী সিবিআই ও এনফোর্সমেন্টের যে তদন্ত আমরা দেখছি সেই তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে যে সব সময় সেই তদন্ত সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না। তার পেছনে থাকছে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। রাজনৈতিকভাবে সরকারি এজেন্সিকে ব্যবহার করে কাউকে রাজনৈতিকভাবে বধ করা, এটাও কোনো নতুন ঘটনা নয়। কংগ্রেস আমলে কংগ্রেস করেছে, বিজেপি আমলে বিজেপি করছে। কংগ্রেস আমলে বিজেপি তো সিবিআইয়ের নাম দিয়েছিল ‘কংগ্রেস ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন’।
আজ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এখন গোটা দেশের সব বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে এজেন্সি কাজ করছে; কিন্তু বিজেপি নামের শাসকদলে যোগ দিলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত হচ্ছে না। ন্যক্কারজনকভাবে এই নগ্ন রাজনৈতিক স্বার্থচরিতার্থ করাও কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো দৃষ্টান্ত নয়।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও তো ভালো নয়। এখন পৃথিবীজুড়ে চলছে আর্থিক সংকট। কভিড পরিস্থিতির জন্য গত দুই বছরে অর্থনৈতিক সংকট আরো জটিল চেহারা ধারণ করেছে। মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি তো আছেই, তার মধ্যে রয়েছে নানা রকমের সন্ত্রাসের সমস্যা। এই ভয়াবহ আর্থিক সংকটে বৃদ্ধির হার যখন ভারতে খুব প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে রয়েছে, তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে। বাংলাদেশের সঙ্গে তো বটেই, নেপাল, ভুটান এবং অন্য সব রাষ্ট্রের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গেও একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। যদিও এখন আনুষ্ঠানিকভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে আলাপ-আলোচনাটা হচ্ছে না; কিন্তু উজবেকিস্তানে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের যে বৈঠক হলো সেখানে মন্ত্রী জয়শঙ্কর গিয়েছিলেন। চীন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া সেখানে তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। জয়শঙ্কর সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান, তালেবান ও চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক না করলেও এসব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একই ছাদের তলায় এসেছিলেন। এই এসসিও বৈঠকে অন্তত পারস্পরিক শত্রুতার আবহটাকে দমন করার চেষ্টা হয়েছে। সেটাও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
এই পরিস্থিতিতে আরো একটা স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বোধ হয় এ রকম একটা প্রস্তাব নেওয়া প্রয়োজন, যেখানে আমরা ভারতবাসী হিংসার পথে নয়, শান্তির পথে এগোব। অগ্রাধিকার দিতে হবে আর্থিক বিকাশ ও উন্নয়নকে, সাম্প্রদায়িকতার হানাহানিকে নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। নানা রকমের ঘটনা ঘটছে। এর ফলে বিভিন্ন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হানাহানি বাড়ছে। এই সাম্প্রদায়িক হানাহানিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে, এই মুহূর্তে যদি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর সরকার উন্নয়ন ও বিকাশের পথে এগোয়, তাহলে সেটা সবচেয়ে ভালো। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস, তার প্রধান বিরোধী নেত্রী সোনিয়া গান্ধীকেই যখন এনফোর্সমেন্ট ডাকছে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁকে গ্রিল করা হচ্ছে, তখন প্রশ্ন উঠছে যে এই তদন্ত কতটা তদন্তের স্বার্থে আর কতটা রাজনীতির স্বার্থে?
কংগ্রেসের বক্তব্য, বিরোধীদের সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে কংগ্রেসমুক্ত ভারতের যে কথা নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, আজ তিনি সেই লক্ষ্যে এগোচ্ছেন। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে সর্বদলীয় গণতন্ত্র বহুত্ববাদী, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের নতুন শপথ নেওয়ার সময় এসে গেছে।