ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে ২০০৫-০৬ সালের দিকে নারী অধিকার রক্ষায় সাম্পাত পাল দেবী নামে এক গৃহবধূ শুরু করেন একটি সংগঠন। ওই গ্রামে এবং আশপাশে যারা স্ত্রীদের মারধর করতো, নারীদের উত্যক্ত করতো, ধর্ষণ করতো, তাদের বিরুদ্ধে বা এলাকার দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ওই নারী সংগঠন। তাদের সদস্যরা রীতিমতো লাঠি-সোটা নিয়ে মারপিট করতো।
বর্তমানে গুলাবি গ্যাং নামে ওই সংগঠন দেশের বহু জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, যাদের সদস্যরা মূলত গৃহবধূ, পরনে থাকে গোলাপি রংয়ের শাড়ি, হাতে লাঠি। তাদের নিয়ে বলিউডে একটি চলচ্চিত্র পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। বিবিসির রিনা স্ট্যানটন শর্মার কাছে গুলাবি গ্যাং তৈরির প্রেক্ষাপটের স্মৃতিচারণ করেছেন সাম্পাত পাল দেবী।
কিভাবে তার মাথায় একটি নারী গ্যাং গঠনের কথা মাথায় আসে?
‘আমি শুধু ভাবতাম কতদিন আর এভাবে সহ্য করবো। কোনো কারণ ছাড়াই মেয়েদের পেটানো হচ্ছে। কতদিন এমন ভয়ের মধ্যে আমরা বাঁচবো?’ বলেন সাম্পাত দেবী।
তার জন্ম ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের প্রত্যন্ত বুন্দেলখান্ডে। এই অঞ্চলে সমাজে-সংসারে নারীর মর্যাদা খুবই নিচুতে। স্বামী বা তাদের স্বজনদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার, মারধর নিত্যদিনের ঘটনা। সেইসাথে রয়েছে নারীদের উত্যক্ত আর ধর্ষণের জন্য তৎপর অপরাধী চক্র।
তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই তার ভেতর ন্যায়-অন্যায় বোধ টনটনে ছিল। ‘কিন্তু আপনি যখন ছোট তখন লড়াই সম্ভব নয়। কিন্তু আমি জানতাম বড় হলে আমি নারীদের বিরুদ্ধে এই অনাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো।’
মাত্র ১২ বছর বয়সে সাম্পাত দেবীকে স্কুল ছাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু লেখাপড়া শেখার স্পৃহা তার যায়নি। গ্রামের ছেলেদের কাছ থেকে সে পড়াশোনা শিখতো। তারপর ১৬ বয়সে সে প্রথম অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলো।
গ্রামের এক পুরুষ প্রায় নিয়মিত তার বউকে পেটাতো। তাকে ঠেকানোর জন্য তিনি পরিবারের কাছে অনেক অনুরোধ করেন, কিন্তু কেউই কোনো পাত্তা দিলো না। ‘একদিন আমি নিজেই এগিয়ে গেলাম। মানুষটিকে মুখের ওপর জিজ্ঞেস করলাম কেন সে প্রতিদিন তার বউকে পেটায়। রেগে গিয়ে মানুষটি আমাকে গালাগাল শুরু করলো। গ্রামের অন্য ক’জন নারীর সাহায্যে মাঠের মধ্যে আমি সেদিন লোকটিকে পেটালাম,’ বললেন সাম্পাত দেবী।
সেটাই ছিল শুরু। এরপর তিনি গ্রামের অন্য বেশ ক’জন নারীকে নিয়ে একটি দল গঠন করলেন যারা বউকে মারধর করার ঘটনার ওপর নজরদারি শুরু করলো। তাদের হাতে থাকতো বাঁশের লাঠি।
‘আমি জানতাম জোটবদ্ধ হলে আমরা অনেক শক্তিধর। তখন বাইরের কারো কোনো সাহায্য লাগবে না। যখন একজন নারী একা কিছু করতে পারবে না, হাজার নারী তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে,’ বলেন সাম্পাত দেবী।
গান গেয়ে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিজেই গান বাঁধতেন সাম্পাত। গানের ভাষা ছিল এরকম – ‘অনেক দিন হয়ে গেছে। ভারতের নারীরা তোমরা এখন জাগো, উঠে দাঁড়াও। আমরা ঘরে কখনই শান্তিতে থাকতে পারিনি। সুতরাং একজোট হয়ে রুখে দাঁড়াও।’
কিভাবে তাদের নাম হলো গুলাবি গ্যাং
সাম্পাত দেবী চাইলেন এই সংগঠনের নারীদের যেন মানুষজন চিনতে পারে। পোশাকের জন্য একটি রং বাছলেন তারা। ‘মেয়েদের কাছ থেকে ১০০ রুপি করে চাঁদা নিয়ে কানপুর থেকে শাড়ি অর্ডার করলাম। তাদের বললাম চলো সবাই একরঙা শাড়ি পরি, যাতে মনে হয় আমরা ইউনিফর্ম পরছি। দেখলাম একমাত্র গোলাপি রং কোনো রাজনৈতিক দল এখনো ব্যবহার করছে না। ফলে আমি ৫০০ গোলাপি রংয়ের শাড়ি অর্ডার করলাম।’ তখন থেকেই এই সংগঠনকে বলা শুরু হয় ‘গুলাবি গ্যাং’। ‘গুলাবি’ শব্দের অর্থ গোলাপি।
২০০৬ সালে নাগাদ এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক হাজার। সে বছরই পুলিশের দুর্নীতি এবং বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ করতে গুলাবি গ্যাং স্থানীয় পুলিশ স্টেশন ঘেরাও করে।
‘পুলিশ একজন নিরপরাধ মানুষকে ১১ দিন ধরে আটকে রেখেছিল। কারণ তার স্ত্রী গুলাবি গ্যাংয়ের সদস্য ছিল। মহিষ চুরির মিথ্যা অভিযোগে পুলিশ লোকটিকে আটকে রেখেছিল। আমি থানায় গিয়ে জানতে চাইলাম কেন এটা করা হচ্ছে? কিন্তু থানার ইন-চার্জ আমার সাথে দুর্ব্যবহার করলো,’ বলেন সাম্পাত দেবী।
তিনি ফিরে যান, কিন্তু গুলাবি গ্যাংয়ের ৩০০ সদস্যকে আশপাশের রাস্তার কুকুর সাথে করে থানায় কাছে জড়ো হতে বলেন। ‘আমি পুলিশকে দেখাতে চেয়েছিলাম তাদের চাইতে রাস্তার কুকুরের ওপর বেশি বিশ্বাস করা যায়, আস্থা রাখা যায়।’
পুলিশের সাথে হাতাহাতি, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায় গুলাবি গ্যাংয়ের সদস্যদের। ‘পুলিশ আমাকে ধরার চেষ্টা করে। আমি তাদের চড় মারি। তারপর আমাদের মেয়েরা থানার ইন-চার্জকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে।’
গুলাবি গ্যাং সেদিন এতই হৈচৈ করেছিল যে ভারতের কেন্দ্রীয় পুলিশের বড় একটি দলকে ওই গ্রামে পাঠানো হলো।
‘সিবিআই’র লোকজন আমাকে জিজ্ঞেস করলো তোমরা সাথে করে কুকুর কেন নিয়ে আসলে? আমি তাদের উত্তর দিলাম পুলিশ যখন বড় কোনো অপরাধ তদন্ত করে তারাও তো তখন কুকুর সাথে রাখে। পুলিশ যদি তা পারে, আমরা পারবো না?’
ছড়িয়ে পড়ছিল গুলাবি গ্যাংয়ের কথা
পুলিশ শেষ পর্যস্ত ওই নিরপরাধ ব্যক্তিতে ছেড়ে দেয়। গুলাবি গ্যাংয়ের সেই বিজয়ের ঘটনা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। জাতীয় বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হয় সেই খবর।
‘বর্তমান পত্রিকায় আমাদের নিয়ে একটি খবর ছাপা হলো। লেখা হয়েছিল সাম্পাত পাল এই সংগঠন শুরুর পর, নারীরা নির্ভয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। সবই সম্ভব হচ্ছে গুলাবি গ্যাংয়ের কল্যাণে,’ গর্বের সাথে বলেন সাম্পাত দেবী।
শুধু ঘরে সহিংসতাই নয়, গুলাবি গ্যাং সমাজের অন্যান্য অনাচার যেমন বাল্যবিবাহ এবং সতীদাহের মতো অনাচারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদে তৎপর হয়।
‘আমি এলাকার নারীদের বললাম, এসব অন্ধ বিশ্বাস এবং কুসংস্কার বন্ধ করতে হবে, এবং অধিকারের জন্য লড়াইয়ে নামতে হবে। আরো অনেক নতুন নতুন নারী আমাদের সাথে একমত হলো। ফলে আমাদের সংগঠন বড় হতে থাকলো,’ বলেন সাম্পাত দেবী।
২০১০ সালে আবারো গুলাবি গ্যাং খবরে এলো। স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনীতিক অল্প বয়সী একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে এবং তারপর তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনে। প্রতিবাদে গুলাবি গ্যাংয়ের সদস্যরা স্থানীয় জেলখানার সামনে টানা ১১ দিন ধরে অবস্থান নেয়। তাদের দাবি ছিল মেয়েটিকে মুক্তি দিয়ে আসল অপরাধী পুরুষোত্তম দিবেদিকে ধরে বিচার করতে হবে। পরে ওই রাজনীতিকের বিচার হয় এবং ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়।
সাম্পাত পাল দেবী বলেন, ওই ক’দিনে ১০ হাজার মানুষ ওই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল। ‘শীতের সময় ছিল তখন। ট্রেনে চড়ে দলে দলে নারীরা আসতো প্রতিবাদে অংশ নিতে। পালাক্রমে একদল আসতো, একদল বাড়ি যেত।’
গুলাবি গ্যাংয়ের কার্যক্রম এখন ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তাদের প্রধান তৎপরতা উত্তর প্রদেশে।
সাম্পাত দেবীর প্রায় নজিরবিহীন এই উদ্যোগ, তার সাহসী-স্পষ্টভাষী আচরণে আকৃষ্ট হয়ে বলিউডও গুলাবি গ্যাংকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র বানিয়েছে।
জনপ্রিয় টিভি প্রোগ্রাম বিগ বসেও হাজির হয়েছেন সাম্পাত দেবী। তবে তার এই কাজে অনেক বাধা-বিপত্তি-হুমকিও এসেছে।
‘আমাকে অনেকবার হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। অনেক অপরাধের সাথে আমাকে জড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমি কোনোদিন এসবকে তোয়াক্কা করিনি। ভয় পাইনি। আমি জানি একদিন না একদিন আমাকে তো মরতে হবে।’
হালে গুলাবি গ্যাং তাদের বাঁশের লাঠি ত্যাগ করেছে। সাম্পাত দেবী বলেন, সহিংস পথের বদলে তারা এখন আলোচনা এবং মিছিল-সমাবেশকে গুরুত্ব দেন।
তিনি বলেন, ‘সরকার ও বিচার বিভাগও আমাদের এখন সহযোগিতা করছে। অপরাধীরা এখন আমাদের নাড়তে ভয় পায়। বরঞ্চ আমি যেখানেই যাই, মানুষজন আমার কাছে এককাপ চা নিয়ে আসে।’
সাম্পাত পাল দেবী মনে করেন ভারতে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে হলেও বদলাচ্ছে।
‘এখন অনেক শিক্ষিত এবং ধনী পরিবারের নারীও আমাদের সংগঠনে যুক্ত হচ্ছেন। এদের অনেকেও এখনো পুরনো সব রীতিনীতি বিশ্বাসের চক্রে জড়িয়ে রয়েছেন এবং লোকলজ্জার ভয়ে ভীত। তারাও বলেন, পুরুষরা তাদেরকে বাড়ির বাইরে যেতে দিতে চায় না। আমি বলি নারীরা যদি বাইরে যেতে চায়, পুরুষের কিছুই করার থাকে না। আমার পরিবারও আমাকে ঘরে আটকে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু আমি তো তা থাকিনি।’