পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি ব্যাপক হারে বেড়েছে। ভারতের হিসাবে গত অর্থবছরে তাদের কাছ থেকে যেসব দেশ পণ্য আমদানি করেছে, তার মধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। দুই বছর আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নবম। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল পঞ্চম স্থানে।
ভারতের অর্থবছর এপ্রিল থেকে পরবর্তী বছরের মার্চ পর্যন্ত। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে সে দেশের পণ্যের এক নম্বর আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র।
দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে যথাক্রমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন এবং বাংলাদেশ। এর আগের অর্থবছরে বাংলাদেশের ওপরে ছিল হংকং। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে জার্মানি, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য এবং হংকংয়ে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের পণ্য রপ্তানি বেশি ছিল। ভারত থেকে আমদানিই শুধু নয়, সে দেশে বাংলাদেশের রপ্তানিও বেড়েছে বড় অঙ্কে। তবে আমদানির সঙ্গে রপ্তানির তফাত অনেক বেশি।
ভারত গত অর্থবছরে সারাবিশ্বে ৪২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে করেছে ১ হাজার ৬১৬ কোটি ডলার, যা তাদের মোট রপ্তানির ৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ৯৬৯ কোটি ডলার, যা ভারতের রপ্তানির ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ।
গত অর্থবছরে ভারত থেকে সর্বাধিক ৭ হাজার ৬১৭ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যা ভারতের রপ্তানির ১৮ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীন থেকে ভারতের রপ্তানি আয় এসেছে যথাক্রমে মোটের ৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং ৫ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ।
বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, করোনার সংক্রমণ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে তুলনামূলক কম দূরত্বের বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্য উচ্চহারে বেড়েছে। তারা মনে করেন, বাংলাদেশকে রপ্তানি বাড়ানোয় মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে তারা মনে করেন।
বাংলাদেশ ভারত থেকে অনেক ধরনের পণ্য আমদানি করে। আমদানির উল্লেখযোগ্য অংশ হলো তুলাসহ তৈরি পোশাকের বিভিন্ন কাঁচামাল। এ ছাড়া প্রধান প্রধান আমদানি পণ্যের তালিকায় রয়েছে পেঁয়াজ, চিনি, ফলসহ ভোগ্যপণ্য, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, লোহা ও ইস্পাত, প্লাষ্টিক ইত্যাদি। ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় রয়েছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য, হিমায়িত খাদ্য, পাট ইত্যাদি।
বাংলাদেশের রপ্তানি : ভারতীয় ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ১৯৮ কোটি ডলারের পণ্য। এর আগের অর্থবছরের চেয়ে যা ৮১ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে তারা ১০৯ কোটি ডলারের পণ্য নিয়েছিল। ভারত গত অর্থবছরে তার মোট আমদানির শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ বাংলাদেশ থেকে নিয়েছে। ভারতের আমদানি গন্তব্যের বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম।
বাণিজ্য ঘাটতি : ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়লেও গত অর্থবছরে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। ভারতের ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানির তুলনায় রপ্তানির পার্থক্য অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৪১৮ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ৮৬০ কোটি ডলার। সব মিলিয়ে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে। বাংলাদেশ ছিল গত অর্থবছরে ভারতের ১৬তম বাণিজ্য অংশীদার। দু’দেশের মধ্যে মোট ১ হাজার ৮১৩ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে বাংলাদেশ ছিল ভারতের ১৯তম বাণিজ্য অংশীদার।
বিশেষজ্ঞ মত : গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, করোনা এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই কাছাকাছি উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে মনোযোগ বাড়িয়েছে।
আবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবকাঠামোগত যোগাযোগের উন্নতিও এ ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে পারে। তিনি বলেন, ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব। এর জন্য রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত মান পরিপালনের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তবে ভারতের বাজারে অনেক সময় অযৌক্তিকভাবে অশুল্ক্ক বাধা আরোপ করা হয়। অশুল্ক্ক বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা এবং রপ্তানিকারকদের নেগোসিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এ গবেষক আরও বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বর্তমানে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা করছে। বাংলাদেশ যথাযথ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এ চুক্তি করলে ভারতে রপ্তানি বাড়বে। একই সঙ্গে এ দেশে ভারতের বিনিয়োগ বাড়বে। ভারতের বিনিয়োগকারীদের উৎপাদিত পণ্য তাদের দেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি হবে। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে।