যে অঞ্চল নিয়ে আজকের বাংলাদেশ, সেখানে ভাষাবিতর্কের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তা সত্ত্বেও ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে আছে বেশির ভাগ বাঙালির কাছে। তবে এই আন্দোলনের ব্যাপ্তি ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সময়টিকেই ঘিরে বলে বেশির ভাগ গবেষকদের লেখায় উঠে এসেছে। এই আন্দোলনকে নিছক বাংলা ভাষার মর্যাদার লড়াই মনে করলে সবটা বলা হবে না। ভাষা মানুষে মানুষে যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ মানুষের জীবনচলার সব পর্বে তার নিবিড় সংযোগ রয়েছে। সেই ভাষার ওপর আঘাত এলে সকল শ্রেণির মানুষই আক্রান্ত বোধ করেন। এর প্রতিবাদে তাই শ্রেণিনির্বিশেষে সকলেই সাড়া দেন। আর সে কারণেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা ছিল অসামান্য। এর শিকড় প্রোথিত ছিল ঐ সময়ের সমাজ ও অর্থনীতিতে।
১৯৪৮ সালের শুরু থেকেই এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সত্যি বলতে, পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রথম গ্রেফতারের শিকার হয়েছিলেন ভাষার দাবিতে আন্দোলনেই। ১১ মার্চ ১৯৪৮-এ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ পালনের কর্মসূচি থেকেই তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। পূর্ব বাংলার উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণির একজন প্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্ব দিলেও তার সঙ্গে গভীর সংযোগ ছিল এ দেশের কৃষক, শ্রমিক ও নিম্নমধ্যবিত্তসহ সাধারণ মানুষের। তাই তো একুশে ফেব্রুয়ারির গণবিস্ফোরণের প্রথম বার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার দাবিতে ছিল না, সেটা ছিল আমাদের জীবন-মরণের লড়াই। আমরা মানুষের মতো বাঁচতে চাই। আমরা খাদ্য চাই, বস্ত্র চাই, আশ্রয় চাই, নাগরিক অধিকার চাই। আমরা কথা বলার অধিকার চাই, শোষণমুক্ত সমাজ চাই।’ (‘সিক্রেট ডকুমেন্টস’, প্রতিবেদন নম্বর ৪৭, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩)।
মূলত ভাষা আন্দোলনই সব শ্রেণির বাঙালিকে তাদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করতে প্রধান সহায়কের ভূমিকা গ্রহণ করতে পেরেছিল। সেই বিচারে এই আন্দোলনের অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বোঝাটা খুব জরুরি। পাকিস্তানি রাষ্ট্রটি ছিল আমলা-মিলিটারি-ব্যবসায়ী ধনিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণাধীন। অভিজন শ্রেণির প্রভাবে এই রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক জীবন চলাকে মসৃণ না করে বরং সমাজে বৈষম্যের বীজ বপন করে চলছিল। বেশির ভাগ মানুষ তাই সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের ওপর ছিল ক্ষিপ্ত। আর এমন পরিপ্রেক্ষিতেই সূচিত হয় ভাষা আন্দোলন। তাই এই আন্দোলন মূলত ছাত্ররা শুরু করলেও এর ব্যাপ্তি ছিল সমাজ জুড়েই। যথার্থ বলা চলে এই আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি তার জাতিসত্তার পরিচয় খুঁজে পায়। তারা অনুভব করে বাঙালিরা একই ভাষাভাষী স্বতন্ত্র একটি জাতি। এই অঞ্চলে আগেও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কৃষক-জনতার বিক্ষিপ্ত আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মতো জাতীয় সামাজিক আদর্শ ভাষা আন্দোলানের আগে এমন করে বের হয়ে আসেনি। ঔপনিবেশিক আমলে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটেছে অসমভাবে। সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শোষণের অবসান হলেও তাদের ওপর নির্ভরশীলতা থেকেই যায়। পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত এলাকাগুলোর ওপর উন্নত এলাকাগুলোর আঞ্চলিক আধিপত্য আরো বেশি করে লক্ষ করা যায়। এ যেন এক নয়া ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা জেঁকে বসল। এই নয়া আঞ্চলিক আধিপত্য অনুন্নত অঞ্চলের বঞ্চিত সব শ্রেণির মনেই জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়কে উসকে দেয় এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ করে। ভাষার ওপর আক্রমণ আসায় এই জাতীয় ঐক্য আরো জোরদার হয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসন আমল এবং পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার স্বাভাবিক পুঁজিবাদী বিকাশ ব্যাহত হয়। সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকেই বাংলার উদ্বৃত্ত ইংল্যান্ডে চালান হয়ে যায়। বাংলার উত্পাদকশ্রেণির টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যায়। অথচ সেদিনের পশ্চিম পাকিস্তানে কোম্পানির শাসন কায়েম হয় ১৮৪৮ সালে। কলকাতাকেন্দ্রিক পাটশিল্পের পশ্চাদ্ভূমি ছিল পূর্ব বাংলা। কলকাতাকেন্দ্রিক আর্থসামাজিক বিকাশেও পূর্ববাংলার কৃষক শ্রেণি (মূলত মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দু) উপেক্ষিতই থেকে যায়। তবে কৃষক সন্তানরাও খানিকটা শিক্ষার সুযোগ পেয়ে বাড়তি শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্যের সুযোগের প্রত্যাশা করে। কিন্তু সে সুযোগ না পেয়ে আঞ্চলিক চেতনার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। ইংরেজ সরকার এই আঞ্চলিক চেতনার সুযোগ নিয়ে কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের প্রধান অংশ পূর্ব বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এক পর্যায়ে বিহার ও উড়িষ্যার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। অন্যদিকে পূর্ব বাংলাকে যুক্ত করা হয় অসমের সঙ্গে। ঢাকাকে করা হয় নতুন প্রদেশের রাজধানী। চট্টগ্রাম বিকল্প রাজধানী। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে এটা করা হয়। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে আঞ্চলিক চেতনা আরও জোরদার হয়। ততদিনে বোম্বাইভিত্তিক পুঁজিপতিদের নেতৃত্বে বিদেশি পণ্য বর্জনের আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করেছে। এই সময়টায় কলকাতাভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি (হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে) বোম্বাইভিত্তিক শিল্প-পুঁজিপতি শ্রেণির সমন্বয় ঘটে। মূলত পূর্ব বাংলার কাঁচামাল ও বাজার হারানোর আশঙ্কায় গড়ে ওঠে ভারতব্যাপী বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। এখানে বোম্বাইভিত্তিক পুঁজিপতি শ্রেণি বিদেশি পণ্য বর্জনের আহ্বান করে অসহযোগ আন্দোলনের নামে জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বে চলে আসে। ফলে কলকাতাভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির একচ্ছত্র নেতৃত্ব আংশিকভাবে ক্ষুণ্ন হয়। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিক ও উঠতি মধ্যবিত্ত এ আন্দোলনকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করতে পারেনি। কেননা, পূর্ব বাংলা আলাদা প্রদেশ হওয়ায় ঢাকাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের বাড়তি কিছু লাভ হয়। ব্যবসায়-বাণিজ্য প্রসার ছাড়াও প্রশাসন, আদালত ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক হওয়ায় তাদের সমৃদ্ধি লাভের সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। তদুপরি বিদেশি পণ্য বর্জনের কারণে বিদেশি সুতা আমদানি ব্যাহত হয়। পূর্ব বাংলার তাঁতশিল্প ক্ষতির মুখে পড়ে। তা সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে থাকে এ অঞ্চলের মানুষের মনে। কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণের এই প্রত্যাশা বেশি দিন স্থায়ী হয় না। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়। ইংরেজদের ওপর পূর্ব বাংলার মুসলিম তথা বাঙালি মুসলিম সমাজের আস্থার অবসান হয়। তারাও ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করে।
এরই প্রেক্ষাপটেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর ফলে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নবাবদের পরিবর্তে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এগিয়ে আসতে শুরু করে। এক পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম যৌথ আন্দোলন স্বদেশি ও খেলাফত আন্দোলনের সমন্বয় ঘটে। বৃহৎ শিল্পপতিদের স্বার্থ জোরাদারে নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখতেই গান্ধী এ আন্দোলনের সমাপ্তি টানেন। আর কিছু ধর্মীয় রক্ষণশীল ধারণার সংযোজন ঘটালে ভারতবর্ষের যৌথ জাতীয় আন্দোলনে ফাটল ধরে। হিন্দু-মুসলমান আলাদা আলাদা পথের সন্ধান করতে শুরু করে। এভাবেই পাকিস্তান ধারণার জন্ম হয়। এই ধারণার মধ্যেই পূর্ব বাংলার ব্যাপক কৃষক সমাজ আপাতত তার মুক্তির পথ খুঁজে পায়। মুসলিম নেতৃত্বের কাছে পাকিস্তান আন্দোলন ‘জাতীয় প্রশ্ন’ সমাধানের সংগ্রাম হলেও সাধারণ মানুষ একে তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন তথা ‘কৃষক প্রশ্ন’ হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। মূলত ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমদের নেতৃত্বের কারণেই পূর্ব বাংলার সামন্তবাদবিরোধী কৃষক শ্রেণি পাকিস্তান আন্দোলনে ব্যাপক হারে অংশগ্রহণ করে। শেখ মুজিব তখন তরুণ নেতা। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কাজ করেছেন। সিলেট গণভোটের সময় তাদের সক্রিয় ভূমিকার কথা অনস্বীকার্য। তাদের প্রত্যাশা ছিল পূর্বাঞ্চলে এমন পাকিস্তান হবে যেখানে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটবে, কৃষক-সন্তানদের শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্যের সুযোগ বাড়বে। এই প্রত্যাশায় বাংলা ফের বিভক্ত হলো।
শেষ পর্যন্ত যে অস্বাভাবিক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি তৈরি হলো তাকে মধ্যবিত্ত কৃষক সন্তানদের কাছে ‘ভ্রান্ত প্রত্যুষ’ বলেই আবির্ভূত হলো। কলকাতা পূর্ব-বাংলার বাইরে পড়ে গেল। হিন্দু জমিদার ও জোতদারদের বেশিরভাগ সম্পদ কলকাতায় স্থানান্তর করল। কালোবাজারিও বেড়ে যায়। পূর্ব বাংলার উদ্বৃত্তের অবশিষ্ট সামান্যই রয়ে গেল। অন্যদিকে পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ভারতীয় মুসলিম শিল্পপতি শ্রেণির একাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। আর ভূমিনির্ভর অভিজাতদের আবাস ভূমি পশ্চিম পাকিস্তান তো আগে থেকেই ছিল। মুসলিম লীগের নেতৃত্বেও ছিলেন তারাই। ফলে পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানি এলিটদের পশ্চাদ্ভূমি হয়ে ওঠে। অথচ নতুন রাষ্ট্রের বেশিরভাগ মানুষের বাস পূর্ব বাংলায়, যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঐতিহাসিক কারণেই অনুন্নত। পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই আশা করেছিলেন পাকিস্তানের শাসকরা এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশি মনোযোগী হবেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উলটো ব্যাপার। পাকিস্তানের রাজধানী চলে গেল পশ্চিম পাকিস্তানে। ব্যবসায়-বাণিজ্য, দপ্তর, আদালত ঐ অঞ্চলকে ঘিরেই গড়ে ওঠে। শিল্পায়ন, আমদানি, বিদেশি সাহায্য—সবকিছুই কেন্দ্রীভূত হতে থাকে পশ্চিমাংশে। কিন্তু রপ্তানির সিংহভাগ (পাট) আসে পূর্ব বাংলা থেকে। আর সেই রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগ খরচ হয় পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। চাকরি বাকরি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবকিছুতেই বৈষম্য। জমিদারি প্রথা ক্ষতিপূরণসহ উচ্ছেদ হওয়ার ফলে জোতদাররা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়। বিদেশি সাহায্যনির্ভর উন্নয়নের সুবিধা পায় পশ্চিম পাকিস্তান। ছিটেফোঁটা সুবিধা পায় পূর্ব বাংলার মধ্যস্বত্বভোগীরা।
নতুন উন্নয়ন কৌশলে সম্পদের সমাবেশ করা হয় ভেতর ও বাইরে থেকে। কৃষি দেয় ভেতরের সম্পদ। আর শর্তসাপেক্ষ বিদেশি সাহায্য দেয় বাইরের সম্পদ। রপ্তানি ক্ষেত্রে দেশি, অপ্রচলিত পণ্যের বাজার সংকুচিত হয়ে গেল। পূর্ব বাংলা শুধু আমদানি-বিকল্প শিল্পের কাঁচামাল জোগান দিত। পূর্ব বাংলার কৃষকদের কাছে তাই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনেরই আরেক রূপ বলে মনে হতো। পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পায়নের ‘বন্দি বাজারে’ই পরিণত হলো পূর্ব বাংলা। এর জন্য প্রস্তুত ছিল না পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মুসলিম লীগের সমর্থক তরুণ কর্মীরা। তারা দারুণ হতাশ তখন। তাই পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রের বিরোধিতা শুরু করে এই তরুণ কর্মীরা। এদের বেশির ভাগই ছিল কৃষকসন্তান। কেউ কেউ আবার এক-প্রজন্মের শহরবাসী। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মনিরপেক্ষ। অনেকেই অস্পষ্টভাবে হলেও বামঘেঁষা। এরাই আওয়ামী মুসলিম লীগের সক্রিয় কর্মী দল হিসেবে বেড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের কৃষকদের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সংবেদনশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদী এক সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। বাংলা ভাষার ওপর আঘাত এলে এরাই তীব্রভাবে প্রত্যাঘাত হানে। তাদের সঙ্গে শুরুতে না হলেও পরবর্তী পর্যায়ে ধীরে ধীরে যুক্ত হয় ব্যাপকসংখ্যক কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক শ্রেণি পূর্ব বাংলার ওপর যে আঞ্চলিক নিপীড়ন চাপিয়ে দিয়েছিল তারই প্রতিফলন ঘটে কখনো সংবিধান, কখনো অর্থনীতি, কখনো ভাষাসংক্রান্ত নীতির মধ্য দিয়ে। ভাষা-প্রশ্নটি ছিল সামনের প্রসঙ্গ। পেছনে ছিল আঞ্চলিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তাই এ বিদ্রোহ ছিল অনিবার্য।
ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ওপর পরিচালিত আমাদের এক জরিপ থেকে জানা যায় যে তিন-চতুর্থাংশই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতি সম্পৃক্ত ছিল। ভাবাবেগে ৬৭ শতাংশ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। ২৫ শতাংশ উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। ৭৩ শতাংশ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বিরোধী ছিল। ৪ শতাংশ মুসলিম লীগ সম্বন্ধে ইতিবাচক, যদিও সবাই পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত ছিল। উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে ব্যক্তিগত ক্ষতির চেয়ে জাতীয় বিকাশ ব্যাহত হবে বলে বেশিরভাগ উত্তরদাতাই মনে করত। অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষার নানা সংকটের মধ্যে তাই ভাষা আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠেছিল। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের শ্রেণি থেকেই বের হয়ে এসেছিল উনসত্তর এবং একাত্তরের জাতীয়তাবাদী ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব। ১৯৪৮-৫২ পর্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে শুভ সূচনা হয়, তারই সফল উত্তরণ ঘটে একাত্তরে। ঔপনিবেশিক ও তার সহযোগী শ্রেণির বিরুদ্ধে অধস্তন শ্রেণিগুলোর (তথা পেটিবুর্জোয়া, ধনী ও মাঝারি ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, কৃষক) এক অভূতপূর্ব সম্মিলন ঘটেছিল বলেই এই উত্তরণ সম্ভব হয়েছিল। তাদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ভাষা-আন্দোলন অধস্তন শ্রেণিগুলোর এক মিলিত চৈতন্যের ফসল।