মাত্র এক মিনিটের ভূকম্পন! নিমেষেই ধংসস্তূপ তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহরগুলো এবং সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ সিরিয়ার সীমান্ত শহরগুলোও। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী হাজার হাজার মানুষ নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছে। এখনো ধংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে রয়েছে বহু মানুষ। এর ফলে প্রাণহানির সংখ্যা প্রতি ঘণ্টায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে ভূকম্পনপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে তুরস্ক অন্যতম। কান্দেরি অবজারভেটরি গবেষকদের মতে, ১৯৩৯ সালের পর এটাই তুরস্কের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূকম্প। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ বলছে, ১৯৩৯ সালেও তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূকম্প হয়েছিল। সে সময় প্রায় ৩৩ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
তুরস্ক ও সিরিয়া থেকে বহু দূরের দেশ বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত রয়েছে ভূকম্পন-পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায়? জাতিসংঘের তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি ভূকম্পের ঝুঁকিতে থাকা দুটি শহরের একটি ঢাকা। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বাংলাদেশ ভূগঠনের কারণে যে কোনো সময় প্রলয়ংকরী ভূকম্প আঘাত আনতে পারে। ভূবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবী প্লেট ও সাবপ্লেট দিয়ে গঠিত। এরকম প্লেটের মাঝখানে যে ফাঁক থাকে তাকে বলে ফল্টলাইন। যেহেতু প্লেটগুলো গতিশীল, তাই দুটি চলন্ত প্লেটের ফল্টলাইনের পরস্পর সংঘর্ষ হলে অথবা হঠাৎ ফল্টলাইনে শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হলে ভূকম্পন সংগঠিত হয়। খুব সহজেই অনুমেয় যে বাংলাদেশ ভূকম্পের কতটা মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। মনে রাখতে হবে, তুরস্কে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, বাংলাদেশে একইরকম ভূকম্প হলে এর ক্ষয়ক্ষতি হবে বহু গুণ বেশি। কেননা ক্ষতি কতটুকু হবে সেটা নির্ভর করে জনসংখ্যার ঘনত্ব, বিল্ডিং, রাস্তাঘাট, অবকাঠামোর মান এবং নগরায়ণ কতটা পরিকল্পিত, উদ্ধার ও ত্রাণকাজে প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞতা ইত্যাদির ওপর। এর সবকিছুতেই আমরা অন্যদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছি।
শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় ৪০ হাজারের অধিক ভবন রয়েছে যেগুলো যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে নির্মিত হয়নি। যার ফলে ঢাকায় বড় ধরনের ভূকম্প হলে পুরো শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণ ঘটবে এবং বিদ্যুতের লাইন থেকেও অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। বাংলাদেশের কি এই বিপর্যয় মোকাবিলা করার সামর্থ্য আছে?
দেশে ঘনঘন ভূকম্প অনুভূত হচ্ছে। মাঝেমধ্যেই মাঝারি ও মৃদু ভূকম্পে কেঁপে উঠছে পুরো দেশ। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প ও সুনামির আশঙ্কার কথা। সুতরাং, প্রশ্ন হলো ভূকম্পের ধকল সামলাতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত? পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা, সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে আগুন কিংবা রানা প্লাজা ধসের চিত্র আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আসলেই আমাদের সক্ষমতা কতখানি। বড় ভূকম্প হলে এরকম রানা প্লাজার মতো বিপর্যয় ঘটবে ঢাকা শহরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ও সড়কে।
ভূকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এটি এমন একটি দুর্যোগ, যার পূর্বাভাস দেওয়ার উপায় বিজ্ঞানীরা এখনো বের করতে পারেননি। তবে বড় ধরনের ভূকম্পের কিছু পূর্বাভাস রয়েছে, যা বাংলাদেশে বেশ লক্ষণীয়। এর লক্ষণ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মৃদু ও মাঝারি মাত্রার ভূকম্প হচ্ছে বেশ কিছু দিন পরপরই। মূলত ভূকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দুটি, প্রথমত ভূকম্পের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে যতটা নিম্নমুখী রাখা যায় এবং দ্বিতীয়ত ভূকম্প-পরবর্তী বিপর্যয় কতটা সামাল দেওয়া যায়। সাধারণত ভূকম্পে বিল্ডিং দুমড়ে-মুচড়ে গায়ে পড়ে না বরং হেলে পড়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। অনেকেই মনে করেন বহুতল ভবন থেকে নিচে নেমে গেলেই হয়তো সাবধানে থাকা যাবে, কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামা অথবা জানালা দিয়ে লাফ দেওয়া আরো বেশি অনিরাপদ। যেহেতু ভূকম্প খুব অল্প সময় স্থায়ী হয়, তাই তাড়াহুড়ো করে রাস্তায় গিয়ে তেমন উপকার হয় না। কেননা বিল্ডিং হেলে গিয়ে তো সে রাস্তার ওপরেই পতিত হয়।
মনে রাখতে হবে, ভূকম্পের সময় যত বেশি মুভ করবেন তত বেশি আহত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সুতরাং যেখানে অবস্থান করছেন সেখানেই ভিম বা কলামের পাশে শক্ত কোনো কিছুর কাছে থাকতে হবে। যেমন :খাট কিংবা শক্ত ডাইনিং টেবিলের পাশে অবস্থান নিলে ভালো হয়। ভূকম্পের বিপর্যয় এড়াতে সরকারকে আরো দৃশ্যমান ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। সরকারের তরফ থেকে যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও ভূকম্প-পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেওয়ার প্রস্তুতিতে যে আমাদের ঘাটতি রয়েছে, সেটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। দেশের প্রতিটি শহরে যেন যথাযথ আইন ও বিধি অনুযায়ী স্থাপনা নির্মিত হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ভূকম্প হলে করণীয় কী—এমন প্রচারাভিযান চালাতে হবে যেন মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি হয়। ফায়ার সার্ভিস, ভূকম্প ব্যবস্থাপনা বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে, ভূকম্প হলে উত্তেজিত না হয়ে সাবধানে সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।