ভূমিকম্প প্রকৃতির শক্তিশালী ও ভয়াবহ এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মানবসভ্যতা ধ্বংসকারী নিষ্ঠুরতম প্রকৃতির প্রতিশোধের রূপ ‘ভূমিকম্প’। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হলেও মাটির নিচের এই দুর্যোগে মানুষের কোনো হাত নেই। শুধু রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপ করা যায়। এই যন্ত্রের নাম সিসমোগ্রাফ। একটি স্প্রিংয়ে ভারী বস্তুর সঙ্গে গ্রাফ অঙ্কন-কলম ও পেপার ড্রামযুক্ত থাকলে যখন ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, তখন মাত্রানুযায়ী গ্রাফ তৈরি হয় এবং সেটা দেখে মাত্রা বোঝা যায়। এই গ্রাফের একক প্রকাশ রিখটার স্কেল। ভূমিকম্পন দেখা যায় না, তবে অনুভব করা যায়।
পৃথিবীর বহু ধ্বংসলীলার কারণ ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কারণে সুনামি-জলোচ্ছ্বাস-সাইক্লোন, নদী প্লাবন, ভূমিধ্বস, ফাটল-ভরাট ও গর্তের সৃষ্টি করে জীবন ও সম্পদ নষ্ট করে। ভূকম্পন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠের অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলায় পৃথিবীতে দেড় কোটিরও বেশি মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড আছে। বিজ্ঞানীরা লক্ষ করছেন, যেখানে নবীন পবর্তমালা, সেখানে শিলাচ্যুতি হলে আকস্মিক ভূ-আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ভু-আলোড়নের ফলে শিলা ধসে পড়লে বা শিলাচ্যুতি ঘটলে কিংবা পাশাপাশি দুটি প্লেটের একটি অপরটির সীমানার তলদেশে ঢুকে পড়লে কিংবা আনুভূমিকভাবে আগে-পিছে সরে গেলে এ ধরনের সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। প্লেটসমূহের সংঘর্ষে ভূত্বকে ফাটলের সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প ঘটায়। ভূত্বকের দুটি স্তরের সংযোগস্থলকে ফল্ট বলে। পৃথিবীর অনেকগুলো ব্লকে একাধিক ট্যাকটোনিক নেট থাকায় ট্যাকটোনিক প্লেট একটির সঙ্গে অন্যটির ঘর্ষণের কারণে একটি প্লেট অন্য প্লেট থেকে স্লিপ করলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু এবং দালান, ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মানবসভ্যতা ধ্বংসের এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ উদ্ধারকাজ ও মানবিক সহায়তায় যোগ দেয়। এই ভূমিকম্পের ধ্বংস দেখে বিশ্ববিবেক সতর্ক ও চমকে উঠেছে। বিশ্বের ইতিহাসে বহু বার বহু ভূমিকম্পে লাখ লাখ মানুষ নির্মমভাবে প্রাণ দিয়েছে।
বাংলাদেশের অবস্থান ভৌগোলিক কারণে ইন্ডিয়ান ও ইউরোপিয়ান প্লেটের সীমানায় হওয়ায় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৮৯৭ সালে ডাউকি ফল্টে ৮.৪ এবং ১৮৮৫ সালে মধুপুর ফ্লটে ৭ মাত্রার এবং ১৭৬২ সালে সীতাকুণ্ডের মিয়ানমার ফল্টে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এসব ফল্টে গড়ে ১০০ বছর আগে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। প্রায় ৪০০ বছর আগে আসাম-সিলেট ফল্টে শক্তিশালী এক ভূমিকম্প হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রজার বিলহাম ও একটি গবেষণা দল তাদের গবেষণায় বলেছিল, সিকিম, ভুটান, আসাম, নাগাল্যান্ড ও সিলেট লাইনে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকাসহ দেশের ৮০ ভাগ ভবন ধ্বংস হয়ে যাবে। ১৯৮৯ সালে ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার কসমোটিয়াম বলেছিলেন, সিলেট-চট্টগ্রাম-বান্দরবন-ময়মনসিংহ-রংপুর প্রলয়ংকরী বলয়ে এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল-বগুড়া-দিনাজপুর-কুমিল্লা-রাঙ্গামাটি বিপজ্জনক বলয়ে অবস্থান করছে। ১৮৯৭ সালে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের গতি পরিবর্তন হয়েছিল। ১৯৪১ সালে আন্দামান সাগরে ভূমিকম্পে সৃষ্ট সুনামিতে ভারতের পূর্ব উপকূলে ৫ হাজারেরও বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটে। দেশের সীমান্তবর্তী প্লেট বাউন্ডরি বিচ্যুতি এবং দেশের ভেতর ডাউকি ও মধুপুর চ্যুতি বিপজ্জনক স্থানে অবস্থান করছে। ভূতত্ত্ব্ববিদদের মতে, প্রতি ১০০ বছর পরপর প্রকৃতির নিয়মেই ভূমিকম্প হয়। এ দেশে ১৮২২ সালের পর ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে শ্রীমঙ্গলে আঘাত হানে। বিবিসি ভূমিকম্পের এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলেছে, বিল্ডিং কোড না মানা এবং দুর্নীতির কারণে তুরস্কে ৬০ লাখ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ধরনের কম্পন বাংলাদেশে হলে উদ্ধারকাজ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। ২০০৯ সালে জাইকার এক জরিপে বলা হয়েছিল, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে এবং ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে ৭ কোটি টন কংক্রিটের স্তূপে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হবে। সরকার বলছে, ২০১৯ সালে উদ্ধারকাজের জন্য ২২০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে এবং ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ এবং প্রয়োজনীয় সেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
প্রায় এক দশক আগে জাপান ও শ্রীলংকার গবেষণা দল সিলেট শহর জরিপ করে বলেছিল, ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৭০-৮০ শতাংশ ভবন ধসে পড়বে এবং ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৮ লাখ লোকের প্রাণহানি পরিবেশ বিপর্যয় এবং গ্যাসফিল্ডের ৯ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে। শ্রীলঙ্কার অধ্যাপক আরঙ্গা পোলাও এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলমসহ সাত জনের গবেষণা দল বলেছে, সিলেট ঝুঁকিতে থাকলেও উদ্ধারকাজ পরিচালনায় কোনো যন্ত্রপাতি নেই। ৩৮টি উপজেলার ১৪টিতে ফায়ার স্টেশন নেই। জহির বিন আলমের মতে, টেকনোকেট প্লেট সিলেটে অবস্থানরত ক্রমেই পূর্বদিকে সরে যাচ্ছে এবং ১০০ বছরে ১ মিটার সরে যায়। ডাউকি ফল্টে ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়াবে এবং ৮ মাত্রার হলে এই অঞ্চল জলশূন্য হয়ে যাবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৮ সালে এক জরিপে বলেছে, সিলেটে ১ লাখ ভবনের ৭৫ ভাগেই ছয়তলার ওপরে এবং বিল্ডং কোড না মেনেই তৈরি করা হয়েছে।
ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূকম্পনের লক্ষণ। ইদানীং সিলেট-ছাতক, খুলনাসহ কয়েক দফা মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভূমিকম্পের আঘাতের চেয়ে উঁচু ভবন থেকে নামার সময় তাড়াহুড়া করে অনেক বেশি প্রাণহানী ঘটে এবং রড-সিমেন্ট উৎপাদনে অনেক ভেজাল থাকায় মেয়াদোত্তীর্ণের আগেই ভবন খসে পড়ে। ভূমিকম্প রোধ করা মানুষের অসাধ্য। তবে সরকারের পাশাপাশি দেশের মানুষ সতর্ক ও সচেতন হলে ভয়াবহ প্রকৃতির এই তাণ্ডব থেকে প্রাণ রক্ষা ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।
আমাদের দেশে বিল্ডং কোড না মেনে বড় বড় ভবন নির্মিত হচ্ছে। ভেজাল রড-সিমেন্টের কারণে মেয়াদত্তীর্ণের আগেই অনেক ভবন খসে পড়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বা বন্ধ করার সুযোগ নেই, তবে সচেতনতা ও সতর্কতার মাধ্যমে ক্ষয় ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। ভূমিকম্প থেকে রক্ষায় সুপারিশগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে—১. দেশের সব হাসপাতাল, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুত রাখা; ২. দেশের সব রড, সিমেন্ট কোম্পানিগুলোতে নির্ভেজাল পণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা; ৩. পুরাতন জরাজীর্ণ ভবন, ছাদের ঢালাই ইট খসে পড়া, ইটের তৈরি ফাউন্ডেশনের ভবনে বসবাস না করা; ৪. প্রতিটি নতুন ভবন তৈরিতে বিল্ডিং কোড মেনে চলা; ৫. নামার সিঁড়ি বড় করে রাখতে হবে; ৬. পাকা ও আধা পাকা কাঁচা ঘরের ছাদে ভারী জিনিস না রাখা এবং বাড়ির আঙিনায় প্রয়োজনীয় খোলা জায়গা রাখা; ৭. সকল স্তরের জনপ্রতিনিধি স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় গ্রামে শহরে স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা এবং ভূমিকম্পের সতর্কতা ও সচেতনতার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া। শহর এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ দালান চিহ্নিত করে লোকজন বসবাসে নিষেধাজ্ঞা জারি করা। সর্বাবস্থায় ভূমিকম্প থেকে বাঁচতে হলে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।