নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিপণনের ক্ষেত্রে আমরা তুমুল প্রতিযোগিতা লক্ষ করছি বাজারে। ভোক্তাদের আকৃষ্ট করতে অথবা বাজারে জায়গা করে নিতে ব্যাপক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে নামিদামি কোম্পানিকেও। বাধ্য হয়ে কোম্পানি তখন বিবিধ সুবিধা প্রদান করে থাকে। যেমন: ওজনে পণ্য বেশি দেওয়া, মূল্য হ্রাস করা অথবা সম্পৃক্ত পণ্যের সঙ্গে ধামাকা অফার জুড়ে বাজারে হইচই ফেলা। মূলত এসব হচ্ছে ভোক্তা আকৃষ্ট করার একধরনের সুকৌশল। সেলফোন কোম্পানিরা এ বিষয়ে আরো এগিয়ে আছেন। বিভিন্ন প্যাকেজের সঙ্গে এমবি ফ্রি দিয়ে তাদের ব্যবসা প্রসারিত করছেন এই সুযোগে। পরিষ্কার কথা, পণ্য মানেই প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারলেই সেই কোম্পানি ব্যবসায়ী হিসেবে সফল। কথা হচ্ছে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অপরাধের কিছু নয়; অপরাধ হচ্ছে পণ্যের মানে ভেজালের উপস্থিতি। মান বজায় রেখে প্রতিযোগিতা চালিয়ে গেলে ভোক্তাদের আপত্তি থাকার কথাও নয়। তবে সেটি যেন অসুস্থ প্রতিযোগিতা না হয়, সেটাই ভোক্তাদের কাম্য। যেমন ভেজাল খেতে খেতে আমাদের এখন খানিকটা সয়ে এসেছে। যেভাবে আমরা ভেজাল খাদ্য খেয়ে আসছি, ঐ হিসাবে কিন্তু আমাদের রোগব্যধি হচ্ছে না। ওপরওয়ালার দয়াও হতে পারে এটি।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে, আগে খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে ভেজাল খেতাম আমরা, এখন আর সেই ভেজালও নেই। সেই ভেজালের মধ্যেই আবার ভেজাল দিচ্ছে অসাধুরা। অর্থাৎ, এক নম্বর নয়, দুই নম্বর ভেজাল খাওয়াচ্ছে আমাদের।
বিস্তারিত জানানোর আগে একটি প্রামাণ্যচিত্র বা ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। ঘটনাটি নিজ চোখে কারো দেখার ইচ্ছা থাকলে নদীপথে ঢাকার আশপাশ থেকে লঞ্চযোগে সদরঘাটে আসতে হবে। তখন দেখা যাবে কিছু অসাধু গোয়ালা দুধের ড্রামে নদীর জল মেশাচ্ছে। একবারে সরাসরি নদীর দূষিত জল দুধে মিশিয়ে তারা ঢাকার অভিজাত মিষ্টির দোকানে সরবরাহ করে থাকে। বিষয়টা ভাবতেও আমাদের ঘেন্না হয়, কারণ সেটি এতটাই দূষিত জল! দুধে জল মেশানো গোয়ালাদের পুরোনো অভ্যাস। কিন্তু সেটি যদি হয় নলকূপের জল, তবু তো মনে সান্ত্বনা মেলে। কিন্তু তা নয়; বরং ভেজালের মধ্যেও ভেজাল দিচ্ছেন অসাধুরা। অর্থাৎ দূষণমুক্ত জল নয়, একেবারে দূষিত ময়লামিশ্রিত ঘোলা জল মেশাচ্ছে। শুধু তাই-ই নয়, কৃত্রিম দুধ-ঘি-ডিম-চাল তৈরির খবরও অনেক আগে জানতে পেরেছি আমরা। অন্যদিকে প্যাকেটজাত দুধের অবস্থা আরো ভয়ানক। বিষয়টি নিয়ে কয়েক বছর আগে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছিল প্যাকেটজাত দুধ-দই নিয়ে তখন। কীটনাশক, সিসা, অ্যান্টিবায়োটিক—এসবও নাকি মেশানো হচ্ছে! এটা কী করে সম্ভব তা ভাবতেও আমাদের গা শিউরে উঠছে।
বলতে দ্বিধা নেই, ভেজালে ভেজালে সয়লাব দেশের পণ্যসামগ্রী কিংবা খাবারদাবার। কোথায় নেই ভেজাল! ওষুধ থেকে শুরু করে কাফনের কাপড়ে পর্যন্ত ভেজাল। শতকরা ৯৫ ভাগ মৌমুমি ফল ও শাক-সবজিতে এখন কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে। মাছ, গুঁড়া মসলা, শিশুখাদ্যে ভেজাল দেওয়া এখন নিত্যদিনের ঘটনা। রোজার মাসে বিষয়টা আরো কঠিন পর্যায়ে পৌঁছে যায়। জিলাপি মচমচে রাখতে মবিল মেশায়। মুড়ি ধবধবে করতে মেশায় ইউরিয়াসহ নানান কেমিক্যাল। কিছু নামিদামি কোম্পানি তরল শরবতের বোতলের লেবেলে বিভিন্ন ফলের ছবি সেঁটে দিলেও ফলের কোন নির্যাস পায়নি বিএসটিআই। শুধু নামিদামি কোম্পানিই নয়, ফুটপাতের দোকানি মাছে দেওয়ার বরফ গলিয়ে এই গরমের মধ্যে শরবত বানিয়ে খাওয়াচ্ছে মানুষকে।
এরকম প্রতিটি জিনিসেই ভেজাল দিচ্ছে অসাধুরা, যার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে আরো অনেক ধরনের খাবারের বিষক্রিয়া ধরা পড়বে। বেরিয়ে আসবে মিশ্রিত বিষাক্ত কেমিক্যালের নামও। অথচ আমাদের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য হইবে।’ কিন্তু দেশে ঠিক উলটোটি লক্ষ করছি আমরা। খাদ্যের পুষ্টিমান দূরের কথা, আসল খাদ্যই পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে আজকাল। এ হচ্ছে ভেজালের সামান্য নমুনা।
ভেজালের কথা আরো আছে, আপাতত এই পর্যন্তই থাক, আবার ফিরে যাচ্ছি মূল্যহ্রাস ও ব্যবসার প্রতিযোগিতার বিষয়ে। আগেই বলেছি, প্রতিযোগিতা দিয়ে টিকে থাকা অথবা পণ্যের মূল্যহ্রাস অপরাধের কিছু নয়; মান নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্যে পুষ্টিগুণ থাকলেই মোটামুটি ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত হয়। এবারের আলোচনা মূল্যহ্রাস নিয়ে হলেও সেটা ভোগ্যপণ্য বা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নয়, সেটি হচ্ছে নেশাজাতীয় দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মূল্যহ্রাসে দেশের কিছু কিছু এলাকায় নেশাসামগ্রী বিক্রি করছে অসাধুরা। মহুয়া (বাংলা মদ), ইয়াবা বা গাঁজার পুঁটলি নিত্যদিনের চেয়ে ক্রেতা বেশি কিনলে মূল্যহ্রাসে বিক্রি করেন তারা। অথবা বড় পুঁটলির সঙ্গে ছোট পুঁটলি ফ্রি দিয়ে থাকেন। এসব হচ্ছে বেশি পর্যটন এলাকায়। কোনো পর্যটক নিরিবিলি বসে থাকলে একধরনের ছদ্মবেশী ফেরিওয়ালা কাছাকাছি এসে নানান কথার ফাঁদে ফেলে নেশাদ্রব্যের অফার দেন পর্যটককে। কথায় কথায় মিলে গেলে মূল্যহ্রাসের অফারও দিয়ে থাকেন। শুধু ছদ্মবেশী ফেরিওয়ালাই নয়, এর সঙ্গে জড়িত থাকে হোটেল বয়রাও। হোটেলে উঠলে পর্যটকের কাছাকাছি গিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বয়েরা মৃদুস্বরে উচ্চারণ করে, ‘লাগব স্যার’? অথবা বলেন, ‘কোন কিছুর দরকার হলে এই নম্বরে কল দেবেন স্যার, এটা আমার পারসোনাল নম্বর।’ তখন আগ্রহী পর্যটকেরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই সুযোগে হোটেল বয়রাও মূল্যহ্রাসের অফারও দিয়ে থাকেন। মূলত এভাবেই তারা নেশাদ্রব্যের মূল্যহ্রাসের ফেরি করেন। তাদের এই অনৈতিক অফারের ফাঁদে পড়ে অনেক যুবক নেশায় আকৃষ্ট হচ্ছেনও। যে মানুষ কখনো নেশায় আসক্ত হয়নি, সেও লোভনীয় অফারের ফাঁদে পড়ে পরবর্তী সময়ে নেশায় আকৃষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ, মূল্যহ্রাসের কুফলে পড়ে ভালো মানুষটিও মাদকাসক্ত হয়ে উঠছে।