২০০৬ সালে বিধানসভা ভোটে বিপুল জয়ের পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের তৎকালীন বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘আমরা ২৩৫’। ২৯৪ সদস্যের রাজ্য বিধানসভায় আসলেই এটা অনেক বড় সংখ্যা। এই বিপুল জয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে কিন্তু বামদের ৩৫ বছরের শাসনক্ষমতা হারাতে হয়। বামদের হারিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। ২০২১ সালে দলটি ২৯৪টির মধ্যে ২১৩ আসনে জিতলেও এখন দলবদলের খেলায় তৃণমূলের বিধায়ক সংখ্যা আরও বেশি। প্রধান বিরোধী দল বিজেপির অবস্থা পশ্চিমবঙ্গে বেশ খারাপ। তবু চাপে রয়েছেন মমতা।
সামনেই গ্রাম দখলের লড়াই— পঞ্চায়েত নির্বাচন। ইতিমধ্যেই তৃণমূল নেতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। আর সেই চিন্তার বড় কারণ নেতাদের বিরুদ্ধে লাগামছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ।
হাওয়াই চপ্পল আর সাদামাটা শাড়িতে মমতার আটপৌরে ভাবমূর্তিতে বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ লেপ্টে দিতে মরিয়া বিজেপি। দলের সর্বভারতীয় সহসভাপতি দিলীপ ঘোষের অভিযোগ, মমতার গুষ্টিসুদ্ধ সব চোর। বিরোধীদের মুখের কথাই শুধু নয়, কলকাতা হাইকোর্ট ইতিমধ্যেই মমতার পরিবারের সম্পত্তির হিসাব তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। অবশ্য মমতাও রাজ্যের মুখ্য সচিবকে তদন্ত করে দেখতে বলেছেন তাঁর নিজের সম্পত্তি। মুখ্যমন্ত্রী যা-ই বলুন না কেন, বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস ‘কালীঘাটের দুর্নীতি’ নিয়ে সুর চড়াচ্ছে। কালীঘাটেই মমতাদের বাসভবন।
২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দুর্নীতির অভিযোগে জেরবার তৃণমূল। ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই মমতার তৃতীয়বার মন্ত্রিসভা গঠনের মাসখানেকের মধ্যেই দুই মন্ত্রীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁরা জামিন পেলেও এখন দুর্নীতির অভিযোগে দলের হেভিওয়েট নেতা পার্থ চ্যাটার্জি জেলে বন্দী। টাকার পাহাড় উদ্ধার হয়েছে পার্থ ও তাঁর বান্ধবীদের বাড়ি থেকে। ধরা পড়ার আগে পার্থ ছিলেন তৃণমূলের মহাসচিব এবং মমতার মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি। তাঁর বিরুদ্ধে স্কুলশিক্ষকের চাকরি বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। চাকরি বিক্রি ছাড়াও কয়লা, গরু, মাদক পাচার নিয়েও তৃণমূল নেতারা অভিযুক্ত। ইতিমধ্যেই দলের আরেক প্রভাবশালী নেতা অনুব্রত মণ্ডলও জেলে।
কয়লা পাচারের অভিযোগে খোদ মমতার ভাতিজা তথা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়মিত জেরা করে চলেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। তাঁর স্ত্রী ও শ্যালিকার বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। তবে তৃণমূলের তরফে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতির অভিযোগ করা হয়েছে। মমতা নিজেও বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে সরব। কিন্তু ইদানীংকালে নেতাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং সম্পত্তির হদিস মিলতেই অনেকটা কোণঠাসা তৃণমূল। বিজেপিও পরিস্থিতির সুবিধা নিতে আক্রমণের ধার বাড়াচ্ছে। গোটা রাজ্যেই তৃণমূল নেতাদের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে পরবর্তী বিধানসভার নির্বাচন ২০২৬ সালে। কিন্তু তার আগে রয়েছে ২০২৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচন। তারও আগে অর্থাৎ আগামী বছর রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে এখনই প্রস্তুতি তুঙ্গে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, দ্রুত জনপ্রিয়তা কমছে তৃণমূলের। তবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিকল্প হিসেবে বিজেপিকে অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। কারণ, বিজেপির বিরুদ্ধে রয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিযোগ। তা ছাড়া, দলের গোষ্ঠীকোন্দলে অনেকটাই জেরবার বিজেপি। গত বৃহস্পতিবারই দলের সংসদ সদস্য অনুপম হাজরা প্রকাশ্যে রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের সমালোচনা করেছেন। ২০১৮ সালে লোকসভা নির্বাচনে ৪২টির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ১৮টি আসনে জিতলেও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় এখনই আসন কমে দাঁড়িয়েছে ১৭। আগামী দিনে তাঁদের আসন আরও কমতে পারে। কারণ, একঝাঁক বিধায়ক ইতিমধ্যেই দল ছেড়েছেন।
এই অবস্থায় বামদের পুনরায় উত্থানের সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে। সামাজিক মাধ্যমেই শুধু নয়, বিভিন্ন সামাজিক কাজেও রেড ভলান্টিয়াররা বেশ জনপ্রিয়। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহ. সেলিমের মতে, রাজ্যের মানুষ তৃণমূল ও বিজেপির ওপর বীতশ্রদ্ধ। একই সঙ্গে তিনি বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের গোপন বোঝাপড়ার অভিযোগ করেছেন। একই অভিযোগ কংগ্রেসেরও।