পৃথিবীর সেরা মহাকাব্যগুলোতে যুদ্ধ আর বীরত্বের জয়-গান যেভাবে করা হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে তখনকার পৃথিবীর সবাই যুদ্ধকে উৎসবের মত করে গ্রহন করেছিলো।
আমরা এখন জানি সে সব ছিলো কল্পলোকের কল্প কাহিনী, কবি’র কল্পনা (ভক্তরা সে সব গল্পকে বাস্তবই মনে করে, তা করুক)। যে যত দক্ষতার সাথে কল্পনা করতে পেরেছেন সে তেমন আকর্ষণীয় ভাবে সে যুদ্ধ সাজিয়েছেন। সেখানে কখনও শুভ-শক্তি এগিয়ে থেকেছে আবের কখনও অশুভ-শক্তি, তবে শেষ বেলাতে শুভরই জয় হয়েছে।
তারই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধ নির্মাণ করে সভ্যতা! নাকি এই সভ্যতা নির্মাণের যুদ্ধই নির্মাণ করে মহাকাব্যিক যুদ্ধ? সে যাই হোক আমরা দেখি এখনও কেন যুদ্ধ চলছে পৃথিবীতে।
বিজ্ঞান প্রমান করেছে মাতৃগর্ভের দখল নেয়া ভ্রুণকে দৌড়ে বিজয়ী হতে হয়, পরাজিত ভ্রুণ প্রাণহীন হয়ে বাতিল হয়ে যায়। এটাও একটা যুদ্ধ! তাই যুদ্ধতো আমাদের জীবন দানকারী শক্তি।
অন্যের ভূখন্ড দখলের শক্তি থাকলেই তা দখলে মেতে ওঠে ‘মসা থেকে মানুষ’ তাই সব প্রাণীই আক্রমন ও আত্মরক্ষার জন্য হাত, পা এবং মুখে কিছু অস্ত্র প্রাকৃতিক ভাবেই পেয়েছে।
সে সব অস্ত্র তারা ব্যাবহার করতে পারে কিন্তু উন্নয়ন করতে পারে না। আর মানুষের অস্ত্র তার মাথা, তাই তারা আদিম কালে পাথরের অস্ত্র নির্মাণ করার পরে নানা স্তর পেড়িয়ে পারমানবিক অস্ত্রে ঠেকেছে।
প্রথম কালে মানুষ তার অস্ত্র ব্যবহার করেছেন নিজেকে বাঁচাতে, এখন আধুনিক অস্ত্র ব্যাবহার করা হয় অপরকে হনন করতে!
মধ্যযুগের যুদ্ধ কাটিয়ে কিছু স্থানীয় ছোট ছোট যুদ্ধ বাদে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত মোটামুটি শান্তিতেই ছিলো পৃথিবী। ১৯১৪-১৯১৮ এর প্রথম যুদ্ধের ২০ বছর পরে আর একটা সর্বাত্বক যুদ্ধ পৃথিবীকে চিরদিনের জন্য পাল্টে দিলো। এসময় আমরা অনেক রকম নতুন অস্ত্র দেখতে পেয়েছি, সিমাহীন ধ্বংস ও রক্তপাত এর ফলে নির্মমতায় ২য় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়িয়ে গিয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বকালের সকল যুদ্ধের নির্মমতাকে।
এর পরে পৃথিবী পেয়েছে জাতিসংঘ, কথা ছিলো তখন থেকে পৃথিবীতে আর কোন যুদ্ধ হবে না। কেউ কাওকে আক্রমন করবে না, সব সমস্যার সমাধান হবে জাতিসংঘে! কিন্তু কী হয়েছে? ত্রাণ বিতরণ ছাড়া জাতিসংঘ আর কী করেছে? শান্তিরক্ষী বাহিনীর নামে আফ্রিকাতে সৈন্য পাঠিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাকে পুরা মহাদেশে বাকি থাকা সম্পদটুকু লুটে নিতে সহায়তা করেছে।
৬৭-এ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ হলো, জাতিসংঘ কী করেছে? কিছুই করেনি। ৬৫তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলো, ৭১এ পাকিস্থান-বাংলাদেশ যুদ্ধ হলো, কী করেছে জাতিসংঘ? দেখেছে আর ত্রাণ দিয়েছে! এই সংঘের যদি কোন ক্ষমতাই না থা্কে তবে এটাকে চালিয়ে নেয়ার দরকার কী? আর যদি রাখতেই হয় তবে বিড়ালের মতো না পুষে ভেটো ক্ষমতা বাতিল করে জাতিসংঘকে সুপ্রিম পাওয়ার দেয়া হোক। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হিসাবে সব দেশকে মেনে নিতে বাধ্য করা হোক, তবেই এর কার্যকারীতা থাকবে, না হয় একটা ক্লাব ছাড়া এর কোন ভূমিকাই থাকবে না পৃথিবীতে।
যে পাঁচ মোড়ল শান্তির ঠিকাদারী নিয়েছে তারাই বারবার বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করেছে, আক্রমনের হুমকি দিচ্ছে বা আক্রমণের মদদ দিয়েছে। তারা যদি সারাক্ষণ এমনই করে তবে পাশের ছোট দেশগুলো দখল নিয়ে তারাই পৃথিবীটা চালাক, মনভাব যদি তেমনই হয় তবে গনতন্ত্র গনতন্ত্র বলে হৈ-হল্লা করার দরকার কী!
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আরও একবার লিখেছি তাই বিস্তারিত নিখছি না, আমরা জানি কেন ইউক্রেন আক্রমন করলো রাশিয়া। যারা ক্লিয়ারলি জানে না তাদের জন্য সংক্ষেপে বলি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে ইউরপের দিকে যে দেশগুলোর জন্ম হয়েছে সেগুলো নিয়ে রাশিয়ার অস্বস্তি ছিল প্রথম থেকেই, অন্যেরা মোটামুটি নিয়ন্ত্রনে ছিলো কিন্তু ইউক্রেনের একটা গ্রুপ বারবার রাশিয়ার জন্য হুমকি হিসাবে সামনে এসে ইউরো এবং নেটোর দিকে হাত বাড়িয়েছে, কিন্তু ইউনিয়ন ভাঙ্গার সময় ইইউ ও নেটো রাশিয়াকে কথা দিয়েছিলো ইউনিয়নের দেশগুলোকে ইইউ এবং নেটোতে নেয়া হবে না। কিন্তু অনেক দিন ধরে নেটো ইউক্রেনকে তাদের সদস্য করার জন্য উৎসাহ দেখাচ্ছে আর তারাও রাশিয়াকে বাদ দিয়ে নেটোর সদস্য হতে উঠেপরে লেগেছে, যার ফলে রাশিয়ার প্রতিপক্ষ তাদের ঘাড়ের উপরে এসে বসতে চাচ্ছে সেটা রাশিয়া মেনে নিবে কেন, যখন তাদের সকল চাহিদা রাশিয়ে পুরণ করে এসেছে এতো বছর? অন্য দিকে ইউক্রেনের বাসিন্দাদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাশিয়ান, ইউক্রেনিয়রা অনেক দিন থেকেই তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলো তাই তাদের রক্ষারও একটা তাগিদ ছিলো। বহুদিনের বিন্দু বিন্দু ক্ষোভ মিলে ক্রেমলিনে একটা আগ্নেয়গিরি জন্ম হয়েছে, সেটারই বিষফোরণ হয়েছে ২০২২ এর ২৪ ফেব্রুয়ারি।
এর পরের গল্প সবাই জানি, এর জন্য এখন আমরা কাকে দায় দিব? কে এর জন্য অপরাধী? নেটো, ইইউ, ইউক্রেন নাকি রাশিয়া? আমার মনে হয় এই যে ২, ৪, ১০টা দেশ মিলে নানা নামে সংগঠণ জন্ম দিচ্ছে তারা নিজেদের বাজার, ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আরও দেশকে তাদের সাথে যুক্ত করতে গিয়ে প্রতিযোগিতায় নিমজ্জিত হয় এবং এ থেকেই প্রতিযোগিতা আর সংঘর্ষ বাড়ে। এ রকমই এক সংঘর্ষ থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
যুদ্ধের গতিবিধি দেখে মনে হয় রাশিয়া যুগযুগ ধরে এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায় যাতে ইউক্রেন কখনও স্টাবল হতে না পারে, দীর্ঘ যুদ্ধে কোন মিত্র থাকে না। এক সময় দাতারা ক্লান্ত হয়ে যাবে, ইউক্রেন নিস্তেজ হয়ে ধ্বংসের মুখে দিশাহীন হয়ে যাবে। তখন রাশিয়া ইউক্রেনের ঘাড়ের উপর দাড়িয়ে থাকবে। তখন ইউক্রেন সব কুল হারাবে।
ইসরায়েলের কথা আর কী বলব? ওল্ড টেস্টামেন্টে আছে ইসরায়েল ইহুদীদের আবাস ভূমি। মানলাম এটা তাদের দেশ ছিলো, এবং প্রায় ৪০০০ বছর ধরে তারা কখনও সেখান থেকে বিতারিত হয়েছে আবার দখল করেছে বা তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই বলে কি এই আধুনিক কালে এসে তাদের হিংস্রতার সাথে সেই দেশ দখল করতে হবে? তবেতো বলতে হয় অমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারত উপমাহাদেশ, আফ্রিকার অনেক দেশ আধিবাসিদের ছিলো। তাদের থেকে তাদের দেশও একই ভাবে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তবে কি তারাও তাদের দেশ ফিরে পাবে? তাদের ফিরিয়ে দেয়া হবে? ইউরোপিয়রা নির্মম ভাবে হত্যা করে সেই জাতিদের প্রায় পুরো নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, সেখানেতো ইহুদীরা অনেক ভাগ্যবান! খ্রিষ্টান ও মুসলিমরা তাদের হাতের মধ্যে নিয়েও নিশ্চিহ্ন করে দেয়নি। তারা যিশুকে হত্যা করেছে, তবুও তাদের রক্ষা করা হয়েছে, তবে কেন তারা একটা জাতিকে এই আধুনিক কালেও নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাচ্ছে?
আমরা জানি, বহু দিনের ক্ষোভ থেকেই ৭ অক্টবরের হামলা, তারা ইসরায়েল পাওয়ার পরে যদি বিনয়ী হত তবে এমন দিন তাদের জীবনে আসত না, এতো সুন্দর জীবন বেঘোরে হারাতে হত না, আমরাও এমন সর্বগ্রাসী যুদ্ধের মুখে পরতাম না। তারা স্থানীয়দের উচ্ছেদ করে ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করবে আর তারা শান্তিতে থাকবে এ কথা ভাবছে কেন?
হামাস ইস্রায়েলে আক্রমন করে তাদের হত্যা করেছে সেটা অনেক বড় মাপের একটা অপরাধ তাতে কোন সন্দেহ নাই কিন্তু তাদের সেই কাজের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ইসরায়েল যে গাজার শিশু ও নিরপরাধ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করছে সেতো আরও বড় অপরাধ। হামাসের অপরাধ যদি ক্ষমা করা না যায় তবে ইসরায়েলের এই চলমান অপরাধের সহযাত্রী হয় কী ভাবে ইউরোপ, আমেরিকা?
চীন, রাশিয়া যদি বর্তমান অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে তবে বিশ্ব শক্তির নিউক্লিয়াস পাল্টে যাবে, কারণ বিশ্ব এখন গনতন্ত্র পরিত্যাগ করছে। আফ্রিকা থেকে গনতন্ত্র প্রায় বিদায়ের পথে, ভারত এখন আরোপিত গনতন্ত্রে আছে, বাংলাদেশের একই অবস্থা। মধ্যপ্রাচ্যতো জানেই না গনতন্ত্র কী? ইরাক, ইরান একই পথে আছে। আফগানস্তান এখন ‘তালেবানস্তান’ দক্ষিণ আমেরিকাও এখন সেই পথে হাটছে। এরা কী গনতান্ত্রীক ইউরোপ-আমেরিকার সাথে থাকবে?
গণতন্ত্রের একটা বড় সমস্যা হল তাদের নিতি প্রায়ই পাল্টে যায় সরকার পাল্টালেই, কিন্তু অটোক্রেসিতেতো কোন দল থাকে না, তাই তাদের পাল্টানোর পথও থাকে না।
গনতান্ত্রিকরা যদি পৃথিবী পাল্টাতে চায় তবে তাদের বিনয়ী হতে হবে, জোর করে ভালো (যে যেটা পছন্দ করে তার কাছে সেটাই ভালো) কিছু করা যায়না। আঘাত করলে প্রত্যাঘাততো ফিরে আসবেই। সে আঘাত শক্ত বস্তু দিয়ে শক্ত পাতের উপর হোক বা কাদামাটিতে আঘাত হোক, প্রত্যাঘাত আসবেই।
ইউরোপ, আমেরিকা মনে করেছিলো চিরদিন এশিয়া, আফ্রিকাকে গণতন্ত্রের কুইনান খাইয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখবে, কিন্তু তারা যে এভাবে আঘাত করবে তা তারা ভাবতেও পারেনি। তাইতো তারা আজ দিশেহারা।