মহামনীষী মহাত্মা স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। জন্ম ১০ এপ্রিল ১৭৭৫, জার্মানির স্যাক্সনির মিসেন নগরে। পিতা ক্রিশ্চিয়ান গটফ্রায়েড এবং মাতা জোহানা ক্রিশ্চিয়ানি হ্যানিম্যান। পিতা চীনামাটির বাসনে নকশার কাজ করে সংসার চালাতেন। নিতান্ত অভাব-অনটনের সংসার ছিল তাদের। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে শৈশবে হ্যানিম্যানের পড়াশোনা শুরু হয়।
বাপ-মায়ের ইচ্ছা ছিল হ্যানিম্যানকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। তার পারিবারিক বলয় ছিল সুস্থ-সুন্দর আবহে ঢাকা। এ কারণে বালক বয়সে তার মধ্যে জ্ঞানার্জনের প্রবল আগ্রহ জন্মে। বাবার ইচ্ছায় ২০ বছর বয়সে তিনি জার্মানির লাইপজিগ শহরে যান। উদ্দেশ্য ছিল কীভাবে জ্ঞানের তৃষ্ণা নিবারণ করা যায়। সেখানে অনুবাদের কাজ করে নিজের খরচ চালাতেন এবং সেখানকার লব্ধপ্রতিষ্ঠিত চিকিত্কদের বক্তৃতা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতেন। এখান থেকেই চিকিত্সা পেশার ওপর তার প্রবল আগ্রহ জন্মে। কিছুদিন এখানে থাকার পর জার্মানির ভিয়েনা নগরে চলে যান। সেখানে ‘ভেষজ বিদ্যালয়ে’ ভর্তি হন। কিন্তু অর্থাভাবে এই বিদ্যালয়ে বেশি দিন থাকা তার সম্ভব হয়নি। পরে ‘ব্রাদার্স অব চ্যারিটি’ নামক একটি চিকিত্সালয়ের প্রধান ভন কোয়ারিনের কাছে চিকিত্সাবিদ্যা শিক্ষা লাভ করেন। এখানেই তার চিকিত্সাবিদ্যায় হাতেখড়ি। ১৭৭৯ সালে তিনি ‘ডাক্তার অব মেডিসিন’ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৭৮৪ সালে ‘স্ক্রফুলাস ক্ষতের চিকিত্সা’ নামক একখানি মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৭৮৭ সালে ‘ঔষধের বিশুদ্ধতা পরিজ্ঞাত হইবার উপায়’ নামক আরো একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। অতঃপর ‘আর্সেনিক দ্বারা বিষ প্রয়োগ’, ‘পটাশ ও লবণ থেকে সোডা প্রস্তুতির কষ্ট’, ‘পিত্ত ও প্লীহা ‘মিশ্রণোপযোগী পারদ প্রস্তুত প্রণালি’, ‘ঔপদংশিক পীড়া এবং নবাবিষ্কৃত পারদ বিষয়ক উপদেশ’ প্রবন্ধসমূহ রচনা ও প্রকাশ করেন।
১৭৯০ সালে জার্মানির দুটি বিজ্ঞান সমাজের সম্মানিত সভ্য নির্বাচিত হন। তার জীবনের বাঁক বদলে দেয় উইলিয়াম কালেনের ‘ভৈষজতত্ত্ব’ অনুবাদকালে পেরুভিয়ান বার্ক বা চায়নার ক্রিয়ার তত্ত্ব। তা জানতে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। এখানেই হ্যানিম্যানের জীবনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। তিনি যেন পেয়ে গেলেন বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। নিজের সুস্থ শরীরে সিঙকোনা বা চায়নার রস কয়েক মাত্রা সেবন করে প্রত্যেক বারেই সবিরাম জ্বরের লক্ষণপ্রাপ্ত হন। পরে এই চায়নার সূক্ষ্ম কয়েক মাত্রা সেবন করে জ্বর থেকে নিরাময় হন। এরপর তিনি উপলব্ধি করেন কোনো কোনো ভেষজে রোগের উত্পত্তি ও নিরাময়ের সক্ষমতা বিদ্যমান। এই কাজে তিনি পুরোপুরি সম্পৃক্ত হন এবং ছয় বছরকাল নানা ভেষজের ওপর পরীক্ষামূলক গবেষণা চালান এবং কৃতকার্য হন। এই বিষয়ের ওপর একটি গ্রন্থও প্রণয়ন করে ফেলেন। ‘নতুন চিকিত্সা প্রণালি’—‘Similia Similibus Curentur’ নামক এক মহাগ্রন্থ রচনা করেন। তার আবিষ্কারের পথ ধরে তিনি একজন উন্মত্ত রোগীকে সুস্থ করতে সক্ষম হন।
১৭৯৬ সালে হুফিল্যান্ডের সম্পাদিত জার্নাল ফর দ্য প্রাকটিসিং ফিজিশিয়ানস পত্রে ‘ওষুধসমূহের শক্তি নির্ণয়ের নতুন প্রথা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধ লেখেন। চিকিত্সাক্ষেত্রে এই প্রবন্ধ তাকে বিপুল পরিচিতি এনে দেয়। জার্মানির কোনিগশ্লাটার শহরে অবস্থানকালে স্বহস্তে প্রমাণিত তার আবিষ্কৃত ওষুধ প্রয়োগ করে বহু রোগী সুস্থ করতে থাকেন। সেই সঙ্গে ওষুধের নামও প্রচার করেন। তার এই সফলতায় তখনকার ঐ সমাজ তাকে ভালো চোখে দেখে না। তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। উপায়ান্তর না দেখে তিনি সপবিবারসহ হামবার্গ শহরে চলে যান, সেখান থেকে মোলেন নগরে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু সেখানেও তার অবস্থান সুখকর ছিল না। পরে তিনি ১৮০৩ সালে নিজ জন্মভূমিতে এসে বসবাস করতে থাকেন। এখানে তিনি ‘কাফি খাওয়ার দোষ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ১৮০৫ সালে তার মৌলিক গ্রন্থ ‘মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা’, ‘অভিজ্ঞতা সিদ্ধ ঔষধাবলি’, ‘অর্গানন’ নামক কালজয়ী গ্রন্থগুলো প্রণয়ন করেন। ১৮৩০ সালে জোহানা হেনরিয়েটা লিওপোন্ডাইন কুচলার তার বন্ধুপ্রতিম জীবনসঙ্গীর মৃত্যু হয়। পরে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন তিনি। ১৮৮৩ সালের ২রা জুলাই এই মহামনীষীর জীবনাবসান ঘটে। কিন্তু মহাকাল থেকে তিনি মুছে যাননি। মানবকল্যাণের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলজ্বল করছেন।
হ্যানিম্যান তার জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন অদম্য ইচ্ছা, কর্মপ্রেরণা, অশেষ ধৈর্য ও অধ্যবসায়-সংবলিত একজন সিদ্ধ পুরুষ। বিস্মিত হতেই হয়, কীভাবে দারিদ্র্যক্লিষ্ট একটি পরিবার থেকে চিকিত্সাক্ষেত্রে মানবকল্যাণের এই বিশাল অর্জন সম্ভব হলো। আজ দুনিয়াব্যাপী হোমিওপ্যাথির সাফল্যগাথা সর্বজনবিদিত। ঘরে ঘরে আজ মানুষের সুস্থতাদানে হোমিও ওষুধ কেমন নিরলস অমৃত ছড়িয়ে যাচ্ছে। তার জীবনের শেষ পর্বে এসে আত্মপ্রত্যয়ে উজ্জীবিত হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বৃথা জীবন ধারণ করি নাই’।