কোরবানির ঈদে খাবারের মেন্যুতে গরু, খাসি, ভেড়া, মহিষসহ বিভিন্ন ধরনের লাল মাংসের পদই বেশি প্রাধান্য পায়। এই লাল মাংস একটানা দীর্ঘদিন ধরে খেলে বা অতিভোজনে শরীরে বাসা বাঁধতে পারে নানা রোগবালাই। এসব থেকে রক্ষা পাওয়ার দাওয়াই দিচ্ছেন পুষ্টিবিদ নাহিদা আহমেদ
সাধারণত প্রচুর পরিমাণে শুকনা মরিচের গুঁড়া, তেল ও মসলা দিয়ে কোরবানির মাংস রান্না করা হয়। মাংস যথেষ্ট সুস্বাদু করার চেষ্টা চলে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে মাংসেও প্রাকৃতিক তেল রয়েছে, তাই অতিরিক্ত তেলে মাংস রান্না করা অযৌক্তিক বা অনুচিত
শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখার অন্যতম শর্ত হচ্ছে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম খাবার গ্রহণ করা। প্রতি মুহূর্তে শরীরের যেসব কোষ ক্ষয় হচ্ছে তা পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন যথাযথ পুষ্টি।
সে জন্য পুষ্টির সব উপাদান থেকে সঠিক পরিমাণে খাবার গ্রহণ করতে হবে।
কেন ও কতটুকু লাল মাংস খাব?
প্রতিদিন একজন সুস্থ ব্যক্তি কতটুকু প্রোটিন খাবেন সেটা নির্ভর করে ওই ব্যক্তির আদর্শ ওজনের ওপর। একজন ব্যক্তির আদর্শ ওজন যদি ৬০ কেজি হয়, তাহলে তিনি প্রতিদিন ৬০ গ্রামের মতো প্রোটিন গ্রহণ করতে পারবেন। কিডনি রোগসহ বিশেষ বিশেষ কিছু রোগে এই পরিমাণ আক্ষরিকভাবে কমতে থাকবে। আবার মেয়েদের মাসিক চলাকালে ও গর্ভকালীন এই প্রোটিনের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
গরুর মাংস থেকে প্রোটিন, ভিটামিন-বি১, বি৩, বি৬ ও বি১২, জিংক, সেলেনিয়াম, ফসফরাস ও আয়রন ভালো পরিমাণে পাওয়া যায়। এই পুষ্টি উপাদানগুলোর স্বাস্থ্যগত উপকারিতাও অনেক। ১০০ গ্রাম মাংসে ৭৪.৩ গ্রাম জলীয় অংশ, ১১৪ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮ মিলিগ্রাম লোহা, ০.১৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন-বি১, .০৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি২ ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়।
তবে কারোরই দিনে ৭০ গ্রামের বেশি মাংস খাওয়া উচিত নয়। গরুর মাংস খাওয়ার নিরাপদ মাত্রা হলো সপ্তাহে দুই দিন বা সপ্তাহে মোট তিন থেকে পাঁচ বেলা। প্রতি বেলায় ঘরে রান্না করা মাংস ১৫ গ্রাম, ২৫ গ্রাম বা ২-৩ টুকরার বেশি খাবেন না।
প্রতি ১০০ গ্রাম লাল মাংসে প্রায় ২৩ গ্রামের মতো প্রোটিন ও ২.৫ গ্রামের মতো ফ্যাট থাকে। কিন্তু ওই ব্যক্তি যদি হিসাব মেলাতে প্রতিদিন প্রোটিনের অন্য সব উৎস বাদ দিয়ে শুধু ২৬০ গ্রামের মতো লাল মাংস গ্রহণ করেন তাঁর ৬০ গ্রাম প্রোটিনের চাহিদা পূরণে, এটি তাঁর জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে।
অতিরিক্ত লাল মাংসে স্বাস্থ্যঝুঁকি কী কী?
প্রতিদিন একটানা ১০০ গ্রামের বেশি লাল মাংস খেলে হৃদরোগে মৃত্যুর আশঙ্কা, ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি, বৃহদন্ত্র ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া অতিরিক্ত লাল মাংস গ্রহণে কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়। লাল মাংস থাকা বিশেষ ইনফ্লামেটরি যৌগ পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্র ক্যান্সারের জন্যও দায়ী। এ ছাড়া ফুসফুসের নানা রোগে আক্রান্ত হওয়া, কোলন ও স্তন্য ক্যান্সারে ভূমিকা রাখে। এমনকি অতিরিক্ত লাল মাংস গ্রহণে আর্থ্রাইটিস, গাউট, পেপটিক আলসার, পিত্তথলিতে পাথর, প্যানক্রিয়াস প্রদাহ ও কিডনি রোগসহ বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করে।
টাটকা লাল মাংসের চেয়ে প্রক্রিয়াজাতকৃত লাল মাংস আরো বেশি ক্ষতিকারক। দৈনিক ৫০ গ্রামের বেশি প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস গ্রহণ হৃদরোগের ঝুঁকি ৪২ শতাংশ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি ৬৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।
সাধারণত কোনো সুস্থ ব্যক্তি সপ্তাহে দুই দিন লাল মাংস গ্রহণ করলে তা তেমন কোনো জটিলতা তৈরি করে না। তবে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি জটিলতাসহ অন্য রোগ থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে মাংস খেতে হবে। যাঁরা হার্টের রোগী বা রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি, তাঁদের গরু বা খাসির গোশত অল্প পরিমাণে খাওয়া উচিত। যাঁদের মেদভুঁড়ি আছে, মোটা বা ওজন বেশি তাঁরা অতিভোজন থেকে দূরে থাকবেন। কেননা অতিভোজন আপনার হার্টের সমস্যার কারণ হতে পারে। বয়োজ্যেষ্ঠ-বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে অনেক সময় মাংস গিলতে ও হজমে অসুবিধা হয় এবং অনেকের দাঁতের সমস্যা থাকে, তাঁদের প্রায়ই মাংসের টুকরা গলায় আটকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই পরিবারে এমন বয়োজ্যেষ্ঠ থাকলে তাঁদের জন্য মাংসের টুকরা ছোট ছোট করে রান্না করতে হবে।
মাংস কেবল নিজেই নয়, কিভাবে রান্না করা হচ্ছে তার ভিত্তিতেও স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়তে পারে। সাধারণত প্রচুর পরিমাণে শুকনা মরিচের গুঁড়া, তেল ও মসলা দিয়ে কোরবানির মাংস রান্না করা হয়। মাংস যথেষ্ট সুস্বাদু করার চেষ্টা চলে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে মাংসেও প্রাকৃতিক তেল রয়েছে, তাই অতিরিক্ত তেলে মাংস রান্না করা অযৌক্তিক বা অনুচিত।
দৃশ্যমান জমানো চর্বি বাদ দিয়ে রান্না করতে হবে। কম তেলে রান্না করতে হবে।
এমনকি অতিরিক্ত মসলার ব্যবহারও কাম্য নয়। পেটের অস্বস্তি এড়াতে মাংস রান্নার উপকরণ সীমিত রাখতে হবে। এ ছাড়া রান্নার উপকরণে কিছু পরিবর্তনও মাংসকে স্বাস্থ্যকর করতে থাকে, যেমন—শুকনা মরিচের গুঁড়ার পরিবর্তে কাঁচা মরিচ ব্যবহার করতে পারেন। মাংস রান্না হয়ে গেলে কিছু অলিভ অয়েল দিতে পারেন। এটি হজমে সাহায্য করে। তাড়াহুড়া করে মাংস রান্না করবেন না, আগে ভালোভাবে রক্ত ধুয়ে ফেলুন। অন্যথায় এটি পেট ব্যথার কারণ হতে পারে।
নিয়ম মেনে মাংস গ্রহণ ও সঠিক উপায়ে রান্না করলে জটিলতামুক্ত থাকা যায়।
♦ রান্নার আগে সম্ভব হলে ৫-১০ মিনিট মাংস সিদ্ধ করে পানি ঝরিয়ে নিলে চর্বির অংশ অনেকটা কমে যায়। উচ্চ তাপে রান্না করতে হবে।
♦ মাংস রান্নার সময় ভিনেগার, টক দই, পেঁপে বাটা, লেবুর রস ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন। এতে চর্বির ক্ষতিকর প্রভাব কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।
♦ যাঁদের উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা আছে বা কোমরবিডিটি আছে তাঁরা একেবারেই না এড়াতে পারলে বিশেষষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে দু-এক টুকরা খেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে মাংস রান্নায় সবজি ব্যবহার করতে হবে। যেমন—কাঁচা পেঁপে, লাউ, চালকুমড়া, টমেটো কিংবা মাশরুম। কিংবা তাঁরা মাংসের সঙ্গে সবজি মিশিয়ে কাটলেট বা চপ করে খেতে পারেন।
♦ প্রতি বেলায় খাবারের সঙ্গে এক কাপ পরিমাণ শসা, লেবু, টমেটো ইত্যাদির সালাদ রাখতে হবে।
♦ খাওয়ার কিছু সময় পর তালিকায় লেবু পানি বা টক দই রাখলেও তা হজমপ্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।
♦ মাংস খাওয়ার সময় ঝোল বাদে খাওয়া ভালো। আবার ভুনা মাংসের পরিবর্তে কম তেলে গ্রিল, বারবিকিউ করে বা কাবাব করেও মাংস খাওয়া যায়।
♦ তিন বেলা মাংসের তৈরি ভারী খাবার না খেয়ে যেকোনো একবেলা একেবারেই হালকা খাবার, যেমন—সবজির স্যুপ, সবজি ও ফলের নানা আইটেম রাখতে পারেন।