মৃত্তিকা একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। পরিবেশের অসংখ্য-উপাদানের মধ্যে মৃত্তিকা অন্যতম। মৃত্তিকা মানবজীবনের আধার। মৃত্তিকা ছোট জীব থেকে শুরু করে মানবগোষ্ঠী পর্যন্ত পরিবেশকে নানা উপাদান জোগান দিয়ে থাকে। মাটির বুকেই মানুষের জন্ম, মাটির ওপরেই মানুষের জীবনযাপন আর মাটির কোলেই চিরশান্তি। মৃত্তিকা ছাড়া মানুষের জীবন কল্পনা করা যায় না। যেখানে মাটি আছে, সেখানে জীবন আছে, সভ্যতা আছে, জীবনের কোলাহল, আনন্দ-উল্লাস আছে। যেখানে মাটি নেই, সেখানে কিছুই নেই।
মাটি মৃত এবং জীবিত উভয় অবস্থায়ই থাকতে পারে। মরুভূমির মাটিতে তুলনামূলকভাবে পানি ও জৈব পদার্থ কম থাকায় মৃত ধরা হয়। তাছাড়া অনেক দিন বৃষ্টি না হলে অতিরিক্ত রোদে বা ইটের জন্য পোড়ালে, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও পেস্টিসাইড ব্যবহারে, লবণাক্ততায়, অতিমাত্রায় ভারী ধাতুর উপস্থিতিতে মাটি তার সক্রিয় গুণাগুণ হারিয়ে মরুভূমির মাটির মতো হয়ে যেতে পারে।
আমরা সাধারণত মাটির ওপরে বসবাসকারী প্রাণীর দিকে বেশি মনোযোগ দিই; কিন্তু ওপরের স্তরের মাটিতেও আরেকটি জীবজগত রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাটির স্বাস্থ্য তথা উৎপাদনশীলতা টিকিয়ে রাখতে মাটির উপরিভাগের উদ্ভিদের বৈচিত্র্যের ভূমিকা ৪২ শতাংশ আর মাটির নিচের আণুবীক্ষণিক জীবের ভূমিকা ৩২ শতাংশ। আমরা যদি এসব আণুবীক্ষণিক জীবদের টিকিয়ে রাখতে মনোনিবেশ করতে না পারি, তাহলে ঐসব প্রাণী যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার তুলনায় আমাদের ক্ষতি হবে অনেক অনেক গুণ বেশি।
গবেষণা বলে, এক টেবিল চামচ জীবিত বা আদর্শ মাটিতে পৃথিবীর লোকসংখ্যার চেয়েও বেশি অণুজীব বসবাস করে। তাছাড়া ১ গ্রাম মাটিতে ৮০ কোটি থেকে ১০০ কোটি ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। (গরুর দুধ থেকে দই তৈরি করতেও ব্যাকটেরিয়া ব্যবহৃত হয়, ১ লিটার দইয়ে কত ব্যাকটেরিয়া থাকে, সংখ্যায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, যারা আমাদের খাদ্য হজমে সহায়তা করে) অণুজীবগুলোর জীবনচক্র সম্পাদনের মাধ্যমে মাটির পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হয়, যুক্ত হয় অসংখ্য জৈব যৌগ। এসব যৌগ মাটি গঠনে ভূমিকা রাখে, ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করে, দূষক পদার্থ ভেঙে দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনে। যারা মাটিতে উদ্ভিদের খাবারকে সহজলভ্য করে তোলে। অণুজীবগুলো পানি ও জৈব পদার্থের উপস্থিতি ছাড়া বাঁচতে পারে না। যাদের উপস্থিতি মাটিতে না থাকলে শুধু গাছ নয়, কয়েক দিনের মধ্যে সারা পৃথিবী অচল হয়ে যেতে পারে।
তারা পচনশীল শাকসবজিকে পাঁচ থেকে ৩০ দিন; মৃত পশু বা প্রাণীর দেহকে ১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে অপচনশীল দ্রব্য, যেমন দৈনন্দিন ব্যবহারের প্লাস্টিক ব্যাগ ১০ থেকে ২০ বছর, প্লাস্টিক বোতল ৪০০ বছর এবং গ্লাস ৪ হাজার বছর পর্যন্ত মাটিতে অবস্থান করে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে দেয়।
উল্লেখ্য যে, এই ক্ষুদ্র অণুজীবগুলো পৃথিবীতে অবস্থানরত সব পচনশীল বস্তুকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে একদিকে পরিবেশকে রক্ষা করে, অন্যদিকে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে এবং সঙ্গে সঙ্গে মাটিকে পবিত্র করে তোলে, যা দিয়ে তায়াম্মুম (মাটি দিয়ে মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করে নেওয়া) করে পবিত্র হয়ে নামাজ পড়ার ও বিধান রয়েছে (আল কুরআন ৫ :৬), যে কাজটি সবচেয়ে মূল্যবান সোনা দিয়ে করার ব্যবস্থা রাখেন নাই। চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, মাটি সোনার চেয়েও মূল্যবান ও পবিত্র।
বর্তমানে, বাংলাদেশে লোকসংখ্যা যে হারে (১ শতাংশ) বাড়ছে, সেই একই হারে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। সেজন্যই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি জমিকে চাষের আওতায় আনার নির্দেশনা দিয়েছেন।
আসলে, প্রতিনিয়তই আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য মৃত্তিকার সঠিক যত্ন নেওয়া ও পরিচর্যা করা উচিত। যেমন
১. মাটির চারটি উপাদানের (খনিজ প্রায় ৪৫, পানি ২৫, বায়ু ২৫ ও জৈব পদার্থ ৫ শতাংশ) মধ্যে বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১ শতাংশ নিচে। মাটিকে সুস্থ রাখতে জৈব পদার্থের প্রয়োগ বাড়াতে হবে। বহুতল ভবন, কাঁচাবাজার ও বিভিন্ন জায়গা থেকেও সংগ্রহ করে অব্যবহৃত শাকসবজি জমিতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
২. জৈবসারের বা জৈব পদার্থের ব্যবহার বাড়িয়ে অতিমাত্রায় রাসায়নিক স্যারের ব্যবহার কমাতে হবে।
৩. সরকার কর্তৃক কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন করার যে উদ্যোগ ২০১০ সালে নেওয়া হয়েছিল তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
৪. গ্রামাঞ্চলে এলোপাথাড়ি ঘরবাড়ি নির্মাণ না করে পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি ঘর নির্মাণ করতে হবে।
৫. কৃষিজমির অপচয় রোধে হাউজিং কোম্পানিগুলোর ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।
৬. সুষম সার প্রয়োগে বা গবেষণার প্রয়োজনে মৃত্তিকা নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
৭. রাসায়নিক সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে এসআরডিআইয়ের সার সুপারিশমালা এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
৮. শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে জমি তৈরিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য সারের সঙ্গে ইউরিয়া সারের এক ভাগ প্রয়োগ করে বাকি দুই ভাগ দুই ধাপে শস্যক্ষেত্রে উপরি প্রয়োগ করলে ভালো হয়। অতি রোদ থাকা অবস্থায় প্রয়োগ করলে অধিকাংশ ইউরিয়া বাতাসে মিশে যেতে পারে, তাই বিকেলবেলায় প্রয়োগের ব্যবস্থা করা ভালো না। সার যাতে মাটির সঙ্গে মিশে যায়, সেজন্য মাটিটা ভিজা রাখা দরকার।
৯. পাহাড় কাটা রোধ ও ওপরের স্তরের (০-৯ ইঞ্চি) মাটি সংরক্ষণের জন্য এই স্তরের মাটি বিক্রয় বা সরানোর ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে মাটি বলতে ওপরের স্তরের মাটিকেই বোঝায়। সমতল ভূমিতে এক ইঞ্চি মাটি তৈরি হতে কমপক্ষে ৫০০ থেকে ১ হাজার বছর সময় লাগে। কাজেই ওপরের স্তরের মাটির দূরত্ব অপরিসীম।
১০. গাছ রোপণে উত্সাহ প্রদান করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি বয়স্ক বৃক্ষ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে এবং ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। গ্রীষ্মের দুপুরে একটি বড় গাছ কমপক্ষে ১০০ গেলন পানি বাতাসে নির্গত করে পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখে। বৃক্ষ শব্দদূষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং সঙ্গে সঙ্গে তারাও আল্লাহ তাআলাকে সেজদা করে (৫৫:৬)। আল্লাহ তাআলা তার সৃষ্টির মাধ্যমে মাটি থেকে ফসল উৎপাদন করে তার কিছু অংশ খড়কুটায় পরিণত করে পুনরায় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন, যাতে মাটিতে বসবাসকারী অণুজীবগুলো খাবার হিসেবে ব্যবহার করে মাটির স্বাস্থ্য ও উর্বরতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আল কোরআনে উল্লেখ আছে (৩৯ :২১) ‘আল্লাহ তাআলা আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তিনি তা জমিনের প্রস্রবণগুলোতে প্রবেশ করান, তিনি আবার তা দিয়ে জমিন থেকে রংবেরঙের ফসল বের করে আনেন, পরে তা আবার শুকিয়ে দেন। যার ফলে তোমরা তাকে পীতবর্ণের ফসল হিসেবে দেখতে পাও এবং তিনি তাকে আবার খড়কুটায় পরিণত করেন।’ এই খরকুটাগুলো অণুজীবগুলোর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং তাদের গলিয়ে-পচিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় এবং এই খড়কুটা থেকে গাছের পুষ্টি উপাদানসমূহ মুক্ত করে আনে। এভাবে মাটির পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বৃদ্ধি করে পরবর্তী শস্যের জন্য পুষ্টি উপাদানের জোগান দিয়ে থাকে। গাছের প্রয়োজনীয় ১৬টি পুষ্টি উপাদানের মধ্যে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ছাড়া বাকি ১৩টি উপাদানই মাটি থেকে আসে, এই ১৩টি উপাদানের মূল উৎস হলো মাটির খনিজ পদার্থ ও জৈব পদার্থ। মাটিতে জৈব পদার্থের মূল উৎস হলো উদ্ভিদ ও প্রাণীর অবশিষ্টাংশ। এই খড়কুটাই হলো জৈব পদার্থ হিসেবে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা ও উর্বরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও পরিবেশের বিপর্যয় থেকে দেশকে বাঁচানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য একটি ফলদ, একটি বনজ ও একটি ভেষজ গাছ রোপণের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
আসুন, আমরা সবাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উল্লিখিত কাজগুলো করার অঙ্গীকার করি এবং আল্লাহতায়ালাকে বেশি করে সেজদা দানকারীর সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাকে গড়ে তুলতে সহায়তা করি।