‘মা’ কথাটি খুব ছোট, অথচ এই শব্দ পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম, যার গভীরতা ব্যাপক। মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও স্নেহের সঙ্গে অন্য কোনো সম্পর্কের তুলনা চলে না। মায়ের স্পর্শেই সন্তান ধীরে ধীরে পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠে। পৃথিবীর সব ধর্মেই এজন্য মায়ের মর্যাদা সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত।
একজন মায়ের কাছে পৃথিবীর সব সন্তানই তার নিজের সন্তান। অনেক ভুল, অনেক অপরাধ—জেনে হোক বা না জেনে হোক—করে ফেলেও মায়ের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা পেয়ে যায় সন্তান। মা সব সময়ই দয়ার সাগর। সন্তান যখন মায়ের সামনে অপরাধ স্বীকার করে দাঁড়ায়, তখন সব মায়ের হৃদয়ই নরম হয়! আপন মহিমায় মা সবাইকে ক্ষমা করেন।
মায়ের এসব অনস্বীকার্য ভূমিকার পরও অনেক মাকে অকালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে হয়। আমরা যদি একটি জরিপের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, ১৯৯০ সালে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল প্রতি লাখে ৫৭৪ জন। ২০১৩ সালে দেশে এই হার ছিল ১৭০। ২০১৫ সালের মধ্যে এই হার কমিয়ে অন্তত ১৫০-এর নিচে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় বটে, কিন্তু তা বাস্তবের মুখ দেখেনি। অর্থাৎ, প্রতি বছর অকালপ্রয়াণ ঘটছে বহু মায়ের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ২০২০ সালে ৮৮৪ জন নারী মারা গেছেন। ২০২১ সালে মারা যান ৭৮৮ জন মা। ২০১০ সালে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু ছিল ১৯৪ জন।
ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১২ হাজার নারী গর্ভধারণ ও গর্ভধারণসংক্রান্ত কারণে মারা যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, গর্ভধারণসংক্রান্ত কারণে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ নারী মারা যান। পাশাপাশি প্রায় সাত মিলিয়ন নারী প্রসব-পরবর্তীতে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। এছাড়া আরো ৫০ মিলিয়ন নারী প্রসবের পর নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় ভোগেন।
মাতৃস্বাস্থ্যের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা অনুধাবন করে ১৯৯৭ সালের ২৮ মে থেকে বাংলাদেশে যথাযথভাবে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়ে থাকে। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।
গুণীজনেরা বলে থাকেন, ‘স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল। এই অবস্থায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে মাতৃস্বাস্থ্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমানোর জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা; প্রসব-পূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী মানসম্মত সেবা ও প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।’
আরো বলা হয়ে থাকে, ‘জাতীয় উন্নয়নে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা অপরিহার্য। এজন্য গর্ভবতী মা ও নবজাতকের মানসম্মত পরিচর্যা এবং রোগ প্রতিরোধে ব্যাপক কর্মসূচির বাস্তবায়ন জরুরি। এক্ষেত্রে নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে মিডওয়াইফরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এজন্য মিডওয়াইফারি শিক্ষাও সার্ভিসকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় রাখা উচিত।’
আধুনিক যুগে মাতৃমৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাই মাতৃমৃত্যু শূন্যে নামিয়ে আনাই হোক আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের অঙ্গীকার। তাহলেই মাতৃত্ব দিবসে মায়ের প্রতি ভালোবাসা হবে স্বার্থহীন।