মায়ের মুখ থেকে শেখা ভাষাকে মাতৃভাষা বলে। এই সম্মানের জায়গাটা কেবল মায়ের জন্যই। যেখানে কথাকেই মানুষের চারিত্রিক গুণাবলির অন্যতম প্রধান উপকরণ হিসেবে ধরা হয়, সেখানে কোনো মা-ই তার সন্তানের খারাপ মুখের ভাষার কারণ হতে পারেন না। একজন মা কখনোই ভাষার অপব্যবহার চান না। ভাষা শেখার সঙ্গে সঙ্গে ভাষার শৈল্পিক ও নান্দনিক ব্যবহারের মাধ্যমে যাতে আমরা যেন নিজের ভালো চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করতে পারি তার প্রাথমিক শিক্ষাটাও মায়ের ভাষার মাধ্যমে শেখা হয়। কিন্তু সন্তান হিসেবে আমরা সেই ভাষার অপব্যবহার করেই মাতৃভাষার অসম্মান করে থাকি।
ভাষার অপব্যবহারের পরিসর বন্ধুমহল বা পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত। ভাষার অপব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক বিষয় উল্লেখযোগ্য। বন্ধুমহলে অশালীন কথাবার্তা থেকে শুরু করে দায়িত্বশীলদের দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তাও এসে পড়ে এর মধ্যে। নিজের মুখের ভাষার সঠিক ব্যবহার নাকি অপব্যবহার হচ্ছে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেই এর সত্যতা মিলবে। একদিকে আমাদের সুন্দর বাচনভঙ্গি ও কথাবার্তা যেমন আমাদেরকে সফলতার শিখরে নিয়ে যেতে পারে, অন্যদিকে সেই একই মুখের ভাষার অনুপযুক্ত ব্যবহার আমাদেরকে তলানিতেও নামাতে পারে।
ভাষার প্রতি সম্মানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নিজের ভাষাকে সম্মানের পাশাপাশি অন্য ভাষাকেও সম্মান করা। দেশ স্বীকৃত ভাষার পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাকেও সম্মানের চোখে দেখার মাধ্যমেও আমরা নিজের মায়ের শেখানো ভাষার সম্মানের স্বরূপ হিসেবে মনে করি। সব ভাষাকেই সম্মানের চোখে দেখা উচিত। রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্রেও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখে বক্তব্য রাখা বা কথা বলার ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার মাধ্যমেও আমরা নিজের মাতৃভাষাকে সম্মান দেখাতে পারি। এছাড়া জনসম্মুখে বক্তব্য দেওয়ার সময় যেসব প্রতিশ্রুতি আমাদের নেতারা দিয়ে থাকেন, সেসব প্রতিশ্রুতি রক্ষার মাধ্যমেও নেতারা তাদের নিজের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখাতে পারেন। জনগণের সামনে মিথ্যা বলে জনগণকে প্রতারিত করা মাতৃভাষাকে অসম্মান করার নামান্তর।
সমাজে জেঁকে বসা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে তার প্রতিবাদ করাও নিজের মায়ের শেখানো ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নমুনা। অন্যায়ের প্রতিবাদের ভাষা জেনেও চুপ থাকা কখনো ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন হতে পারে না। সঠিক জায়গায় সঠিক কথা বলে নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রেখে অন্যায়ের প্রতিবাদ করাতেই ভাষার সমান।
আমরা নিজের মা-বোনের অধিকার রক্ষায় যদি নিজের মায়ের ভাষাই ব্যবহার করে প্রতিবাদ করতে না পারি, তাহলে কীভাবে মূল্যায়ন করলাম মায়ের ভাষাকে? কীভাবে সম্মান দেখালাম মায়ের ভাষাকে? মায়ের অধিকার রক্ষায় নিজের ভাষাকে, নিজের কণ্ঠকে আমরা যদি উঁচু করতে না পারি, তাহলে মায়ের ভাষার সম্মান রাখতে পারব না। মায়ের অধিকার রক্ষায় নিজের প্রতিবাদী কণ্ঠকে উঁচু রাখার মাধ্যমেও আমরা মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে পারি। আমরা নিজেরাই যদি নিজেদের মুখনিঃসৃত ভাষাকে মূল্য না দিই, নিজেরায় যদি কথা দিয়ে কথা না রাখি, নিজের কটু কথার মাধ্যমে অন্যকে কষ্ট দিই, গালাগালির মাধ্যমে অন্যকে কষ্ট দিই, তবে কথার মধ্য দিয়ে আমাদের ভাষার অসম্মান করছি আমরাই। এর বিপরীতে কথার মধ্যমে অন্যের উপকার, ভালো পরামর্শ, সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার মাধ্যমেও ভাষার প্রতি সম্মান দেখাতে পারি।
রক্ত দিয়ে অর্জিত মাতৃভাষা বাংলাকে যথাযথ মূল্যায়ন শুধু শহিদ মিনারে ফুল দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বছরে শুধু এক দিন ফুল দিয়েই ভাষা ও ভাষাশহিদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের গুরুত্ব কখনো পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় না। ভাষাশহিদদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া ভাষাকে সম্মান করতে হলে উপর্যুক্ত ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহারকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের মুখের ভাষার সঠিক ব্যবহারের মধ্যেই ভাষার জন্য শহিদ হওয়া বীরদের প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন করা হবে। এ সত্য আমরা যেন ভুলে না যাই।