পুরান ঢাকার সূত্রাপুর থেকে ৬৮ বোতল ফেনসিডিলসহ ফারুক নামে এক ব্যক্তিকে ২০০৪ সালে গ্রেপ্তার করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তাঁর বিরুদ্ধে সূত্রাপুর থানায় মামলা হয়। গত বছরের নভেম্বরে মামলাটির রায় দেন আদালত। রায়ে ফারুক খালাস পান।
শুধু ফারুকই নন; মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) করা মাদক মামলায় নানা ত্রুটির কারণে অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত- আট বছর চার মাসে সারাদেশের আদালতে ডিএনসির ১৮ হাজার ৫৪০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার ৫৫টি মামলা খারিজ হয়ে গেছে, যা মোট মামলার ৫৪.২৩ শতাংশ। ৪৫.৭৭ শতাংশ মামলায় অভিযুক্তদের সাজা হয়েছে। মোট মামলায় অভিযুক্তের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার ৪৯০। এর মধ্যে খালাস পেয়েছেন ১১ হাজার ৫৯৯ জন, যা মোট অভিযুক্তের ৫৬.৬০ শতাংশ। সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ৮ হাজার ৮৯১, যা ৪৩.৩৯ শতাংশ। ২০১৪ সাল থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত মাদকের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৭৩ হাজার ৩১২। ডিএনসি থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, পাবলিক সাক্ষীদের আদালতে আসার বিষয়ে অনীহা রয়েছে। আসামিদের সঙ্গে তাঁদের যোগসাজশও থাকতে পারে। কেউ কেউ সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হলেও সঠিক কথা বলেন না। এ ছাড়া মামলা-সংক্রান্ত কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর তাঁরাও সাক্ষ্য দিতে আসতে চান না। মামলা যাতে আদালতে সঠিকভাবে উপস্থাপন হয় এবং সাক্ষী আদালতে এসে সঠিক কথা বলেন, সে ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা আছে।
২০১৪ সাল থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত নিষ্পত্তি হওয়া মামলার তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, মাদক মামলায় অভিযুক্ত খালাসের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। তবে মাঝপথে সামান্য একটু সাজার সংখ্যা বাড়ে। প্রতিবছর সাজার সংখ্যা কমে যাওয়া এবং খালাসের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে নানা কারণ রয়েছে। কয়েক বছর আগে খোদ ডিএনসির এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছিল, আট কারণে মাদক মামলায় অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। প্রধান কারণ হিসেবে উঠে আসে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের অভাবের বিষয়টি। অন্যান্য প্রধান কারণ হিসেবে উঠে আসে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের অভাবের বিষয়টি। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে- ত্রুটিপূর্ণ এজাহার দাখিল, তদন্তে ত্রুটি-বিচ্যুতি, মামলায় সফলতা অর্জনের মৌলিক প্রশিক্ষণের অভাব আছে তদন্ত-সংশ্নিষ্টদের। জব্দ তালিকায় উপস্থিত সাক্ষীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর বক্তব্যের অমিল। জব্দ তালিকার গরমিল। উপযুক্ত নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপনে ব্যর্থতা। মামলার বাদী এবং অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের বক্তব্যে অমিল থাকা। অনেক ক্ষেত্রে বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তাও সাক্ষ্য দেন না। ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে স্বপ্না নামে এক মাদক কারবারিকে দেড়শ গ্রাম গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করে ডিএনসির ঢাকা মহানগর উপ-অঞ্চলের রমনা সার্কেল। এই সার্কেলের একজন কর্মকর্তা বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন। চার্জশিটে সাতজন সাক্ষীর কথা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন আদালতে। বাদী সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হননি।
এসব কারণে ২০১৭ সালের নভেম্বরে মামলাটির রায়ে অভিযুক্ত খালাস পান। ২০১৬ সালে কামাল হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে হেরোইনসহ গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। পল্টন থানায় কামালের বিরুদ্ধে মামলা হয়। গত ২৪ মার্চ যুগ্ম মহানগর তৃতীয় আদালত রায় দেন। নানা ত্রুটির কারণে অভিযুক্ত কামাল খালাস পেয়েছেন। ২০১৭ সালের এপ্রিলে দক্ষিণখান থেকে ৫০০ পিস ইয়াবাসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। এ ঘটনায় দক্ষিণখান থানায় মামলা হয়। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার ৪ নম্বর যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ মামলাটির রায় দেন। এজাহারে ত্রুটি, জব্দ করা আলামত আদালতে শনাক্ত না হওয়া এবং রাষ্ট্রপক্ষ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় কারও সাজা হয়নি।
মামলার এজাহার ও তদন্তের ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে এজাহার লেখা হয় না। তদন্তে থাকে দুর্বলতা। এ ছাড়া দুর্বল চার্জশিটসহ নানা কারণে মাদক মামলায় আসামি খালাস পেতে পারেন। তিনি বলেন, অনেক সময় আসামিপক্ষ সাক্ষীদের ম্যানেজ করে ফেলায় সাক্ষী আদালতে এসে উল্টোপাল্টা সাক্ষ্য দেন। কিছু কিছু সাক্ষী এসে বলেন, তাঁদের সামনে মাদক উদ্ধার হয়নি। আদালতে মামলা প্রমাণ করতে হলে সাক্ষীর মাধ্যমেই প্রমাণ করতে হবে। এর পরও আমরা সঠিকভাবে সাক্ষী নিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করি। কিন্তু মামলা ও চার্জশিটে দুর্বলতা থাকায় প্রমাণে সমস্যা হয়।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে মোট মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২ হাজার ৬৮৯টি। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত আসামির হার ৫২ শতাংশ। ২০১৫ সালে মামলা ও সাজার হার কমে আসে। এ বছরে নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৮৭৩টি মামলা; যার মধ্যে আসামির সাজা হয়েছে ৮৯২টি মামলায়, যা মোট মামলার ৪৭.৬ শতাংশ। আগের বছরের সাজার তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ কম। সাজাপ্রাপ্ত আসামির হারও প্রায় চার ভাগ কমে আসে। এ সময়ে ৪৮.২ শতাংশ আসামির সাজা হয়। ২০১৬ সালে নিষ্পত্তি হওয়া ৫ হাজার ৩৪৮টি মামলার মধ্যে ২ হাজার ৯৯২টিতে অভিযুক্তরা খালাস পেয়েছেন। সাজা হয়েছে ৪২ শতাংশ মামলায়। ৩৯ ভাগ আসামির সাজা হয়েছে। ৬১ ভাগ অভিযুক্তই খালাস পান। আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৯ ভাগ বেশি অভিযুক্ত খালাস পেয়েছেন। ২০১৭ সালে নিষ্পত্তি হওয়া মোট মামলার মধ্যে সাজা হয়েছে ৪০ ভাগ মামলায়। এ বছরেও আগের বছরের তুলনায় ২ শতাংশ কমেছে। সাজা হয়েছে ৪০ শতাংশ আসামির। বাকি ৬০ শতাংশ খালাস পেয়েছেন। অবশ্য ২০১৮ সালে নিষ্পত্তি হওয়া মোট মামলায় ২০১৭ সালের চেয়ে সাজা বেড়েছে ২ শতাংশ। অর্থাৎ সাজা হয়েছে ৪২ শতাংশ মামলায়। সাজাপ্রাপ্ত আসামির হার ৪১ শতাংশ। আগের বছরের চেয়ে ২০১৯ সালে আবার ৩ শতাংশ মামলায় সাজা কমেছে। নিষ্পত্তি হওয়া মোট মামলায় সাজা হয়েছে ৩৯ শতাংশ। ১ হাজার ৭৬৫ অভিযুক্তের মধ্যে সাজা হয়েছে ৬৭৮ জনের, যা ৩৮ শতাংশ। ২০২০ সালে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে ৫৭ ভাগ মামলা খারিজ হয়েছে। সাজা হয়েছে ৪৩ শতাংশ আসামির। ২০২১ সালে নিষ্পত্তি হওয়া মোট মামলার মধ্যে খারিজ হয়েছে ৬০ শতাংশ। সাজাপ্রাপ্ত আসামির হার ৫০ শতাংশ। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত নিষ্পত্তি হওয়া মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এই চার মাসে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে ৫১ শতাংশ খারিজ হয়েছে। সাজাপ্রাপ্ত আসামির হার ৪২ শতাংশ।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, মাদক মামলার সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠীর সংশ্নিষ্টতা থাকে। তাঁরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবেও খুব শক্তিশালী। ফলে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হলেও পরে ত্রুটিপূর্ণ চার্জশিট এবং প্রভাবশালীদের প্রভাবে মামলাগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে দুর্বল হয়ে যায়। এর ফলে বেশিরভাগ অভিযুক্ত খালাস পেয়ে যান।