‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য! একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না…ও বন্ধু!’—মানবতার এই চিৎকার গানের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ রইল না। প্রথম বারের মতো মানবতা জিতে গেল মরণোত্তর কিডনি দানের মাধ্যমে। নাটক কিংবা সিনেমায় নয়, বাস্তবেই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো মৃত ব্যক্তির কিডনি মানব দেহে প্রতিস্থাপনের ঘটনাটি ঘটল। এই নজিরবিহীন মানবতা রচনা করলেন ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য। মৃত্যুর আগে নিজের দুইটি কিডনি ও দুইটি কর্নিয়া দান করে যান তিনি। ইতিমধ্যে তার দান করা কিডনি দুইটি অন্য দুই মহিলার দেহে সফলভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিডনি ফাউন্ডেশনের একদল চিকিৎসকের দীর্ঘ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপিত হলো। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চিকিত্সাজগতে এমন মানবিক ও মহৎ উদাহরণ রচিত হলো। সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্যের এই মহান ত্যাগ আমাদেরকে গর্বিত করেছে।
এক জরিপে উঠে এসেছে, আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা বেশ কয়েক বার এ কাজের চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। যদিও ভারতে প্রায় সাত-আট বছর আগে থেকেই এমনভাবে মরণোত্তর কিডনি দান করে মৃত্যুকে জয় করার কাজটি চালু আছে। টেলিভিশনের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে সাড়ে ৩ হাজারের মতো কিডনি প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। অথচ যে হারে কিডনি বিকল হচ্ছে মানুষের, তাতে প্রতি বছর কয়েক হাজার কিডনির চাহিদা রয়েই যায়। এই অবস্থায় মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে সংগৃহীত কিডনি নিয়মিতভাবে প্রতিস্থাপন সম্ভব হলে কিডনি প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়ায় গতি আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপনে খরচ পড়বে বেশ কম—সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকার মতো। যা রোগীর পরিবারের ওপর বোঝা অনেকটা হালকা করবে। এমনটাই মনে করছেন খোদ বিশেষজ্ঞরা।
একজন মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে কর্নিয়া, কিডনি, লিভার, হার্ট, ব্রেইনসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগ্রহ করে আলাদাভাবে মোট আট জন রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব। প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে হাজার হাজার রোগী মারা যান। এসব রোগীর মৃত্যুকে জয় করা সম্ভব অঙ্গদাতাদের মাধ্যমে! অবশ্য এমন সাংঘাতিক আশার মধ্যেও রয়েছে উদ্বেগ। অঙ্গদান নিয়ে সমাজের কোনায় কোনায় রয়েছে নানা রকম কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি। তবে ধর্মীয় গুরুদের মাধ্যমে সঠিক ব্যাখ্যা প্রচার করে মরণোত্তর অঙ্গদানের প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করা সম্ভব।
প্রথম মরণোত্তর কিডনি দানকারী তথা সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য আমৃত্যু জীবিত থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। চিকিৎসাসেবার ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তার নাম। তার এই মহৎ উদ্যোগ শুধু দুই জন নারীর জীবনে আশার আলো জ্বালায়নি, বরং ভবিষ্যতের অসংখ্য মানুষের জন্য খুলে দিয়েছে আলোর দুয়ার। সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য পুরো দুনিয়ার কাছে আজ ‘মানবতার কন্যা’ নামে অবিহিত। মৃত্যুর আগে তিনি কিডনি, কর্নিয়া দানের পাশাপাশি পুরো দেহ গবেষণার জন্য দিতে চেয়েছিলেন। তার ইচ্ছা ছিল তার ব্রেন নিয়েও গবেষণা হোক। এমন উদার ও মানবিকতার দৃশ্য ইতিহাসে বিরল! সদ্য কিশোরী থেকে তরুণী হয়ে ওঠা মেয়েটা নিজের নামের মতো করেই নিজের মৃত্যুকে ঐশ্বর্যময় করে রেখে গেল। কবিতার মতো করে মৃত্যুকে সুন্দর ও পবিত্রময়ী করা মেয়েটা বাংলার বুকে আজীবন মানবতার নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবে।