বিশ্বের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় রাখিয়া কিছুকাল আগে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেস বলিয়াছিলেন, ‘মানবাধিকার অর্জন করিলে এবং সকল মানুষের জন্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হইলেই কেবল একটি টিকসই শান্তি আসিবে, একটি ন্যায়পূর্ণ বিশ্ব পাওয়া যাইবে।’ তাহার এই দৃষ্টিভঙ্গির ওপর আমাদের শ্রদ্ধা রহিয়াছে। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে আমাদের প্রশ্ন থাকিয়া যায়, এই মানবাধিকারের সংজ্ঞা কী? ইহা কোন অধিকারের মধ্যে পড়ে? পৃথিবীতে হাতেগোনা দুই-একটি মাত্র দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন লইয়া কোনো প্রশ্ন নাই। কিন্তু বাদবাকি বিশ্বের কোথাও কি গুতেরেস সাহেবের কাঙ্ক্ষিত মানবাধিকার রহিয়াছে?
বাংলায় আমাদের বেশ কিছু প্রবাদ প্রচলিত আছে। বলা হয়, দেশের ঠাকুর, বিদেশের কুকুর। আবার বলা হয় এক দেশের গালি, আরেক দেশের বুলি। ইহার অর্থ হইল এক দেশে যাহা নমস্য আরেক দেশে তাহার কোনো মূল্য নাই। আবার এক দেশে যাহা তুচ্ছ অথবা ঘৃণিত, অন্য দেশে তাহাই সমাদৃত।
বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন জনপদ গড়িয়া উঠিয়াছে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধ লইয়া। সেই মূল্যবোধের আলোকেই তৈরি হইয়াছে মানবাধিকারের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ। যেই সময় ঘরের দরজার সামনেই পুলিশ ছিল না, পুলিশ ডাকিতে দুই দিন ভরিয়া নৌকায় চড়িয়া গঞ্জে যাইতে হইত, সেই সময়ও সমাজ চলিয়াছে অলিখিত কিছু মূল্যবোধকে ভিত্তি করিয়া। অবশ্য দুষ্ট মানুষ সেই সময়েও ছিল, এখনো এই মানবাধিকারের যুগেও আছে।
আবার আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রহিয়াছে তিন প্রকারের রাষ্ট্রব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মীয় অনুশাসনভিত্তিক। এবং এই তিনটি ব্যবস্থার মধ্যেই রহিয়াছে বিস্তর ফারাক, বৈপরীত্য। প্রত্যেক ব্যবস্থাতেই মনে করা হয়—তাহারাই শ্রেষ্ঠ কথাটি, সঠিক কথাটি বলিয়াছে। সুতরাং মানবাধিকার এক কথায় সুনির্দিষ্টকরণ বড়ই দুরূহ কাজ। পশ্চিমের যাহারা মানবাধিকারের কথা বলিয়া থাকেন, তাহারা তাহাদের বলা ভার্শনে দৃঢ় থাকিতে চাহেন, অন্য স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় রাখিতে নারাজ। পৃথিবীব্যাপী রহিয়াছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। সেই মূল্যবোধকেও আমরা উপেক্ষিত হইতে দেখি মানবাধিকারের প্রশ্নে। সেই কারণেই পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারায় আল্লাহতালা ইরশাদ করিয়াছেন, ‘নিশ্চিত যাহারা কাফের হইয়াছে, তাহাদেরকে আপনি ভয় প্রদর্শন করুন আর না-ই করুন, তাহাতে কিছুই আসে-যায় না (আয়াত ৬)। ‘আল্লাহ তাহাদের অন্তকরণ এবং তাহাদের কানসমূহ বন্ধ করিয়া দিয়াছেন, আর তাহাদের চক্ষুসমূহ বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। তাহাদের জন্য রহিয়াছে কঠোর শাস্তি (আয়াত ৭)’। সুরা বাকারার ১৩ নম্বর আয়াতে বলা হইয়াছে, ‘আর যখন তাহাদেরকে বলা হয়, অন্যরা যেইভাবে ইমান আনিয়াছে, তোমরাও সেইভাবে ইমান আনো, তখন তাহারা বলে, আমরাও কি ইমান আনব বোকাদের মতো! মনে রাখিও, প্রকৃত অর্থে তাহারাই বোকা, কিন্তু তাহারা তাহা বোঝে না।’
অতএব প্রশ্ন থাকিয়াই যায়, কে নির্ধারণ করিবে মানবাধিকার কোনটা এবং কোনটা নহে? কে নির্ধারণ করিবে সেই মানবাধিকার সঠিক কি না? সুতরাং সভ্যতার সংকট হইতে বাহির হওয়া এখনো দুঃসাধ্যই রহিয়া গিয়াছে। তাই সাম্প্রতিক কালে সভ্যতার সংকট লইয়া অনেক বাদানুবাদ পরিলক্ষিত হয়। ‘ক্লাস অব সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ নামে একটি গ্রন্থও বিশ্বব্যাপী বহুল পঠিত হইয়াছে, যাহা লিখিয়াছেন স্যামুয়েল হান্টিংটন। শুধু সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা নহে, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রেই মানুষে মানুষে, দেশে দেশে, জনপদে জনপদে তফাত রহিয়া গিয়াছে । যাহাকে জোর করিয়া এক ঘাটে আনিবার কোনো সুযোগ নাই। দুঃখের বিষয়, শুধু সমরবিদ্যাতেই সকল দেশের দৃষ্টিভঙ্গি একরকম। আর এই সমর কেবল মানুষ হত্যা করিয়া থাকে, মানুষকে মানবাধিকার দিতে পারে না।