বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ নেই জাতিসংঘের। গুম-খুনের মতো বিশেষ মানবাধিকার নিয়ে সমস্যা ও উদ্বেগজনক অবস্থায় থাকা দেশগুলোর তালিকায় নেই বাংলাদেশের নাম। সদ্য বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের এমন প্রতিবেদনের পর স্বস্তি ফিরেছে ক্ষমতাসীন মহলে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার ইস্যুকে গুরুত্ব দেয় জাতিসংঘ। এ নিয়ে দেশের ভেতরে বিভিন্ন মহলের বড় ধরনের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করেন মিশেল ব্যাচেলেট। সফরকালে বিভিন্ন মহল থেকে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানান তিনি। এ বিষয়ে এক দীর্ঘ বিবৃতিও দেন তিনি। সরকারের পক্ষ থেকেও মানবাধিকার প্রশ্নে গৃহীত পদক্ষেপের বিস্তারিত জানানো হয় ব্যাচেলেটকে।
মিশেল ব্যাচেলেটের বাংলাদেশ সফরে সরকার এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মানবাধিকার বিষয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত দেয়া হয়েছিল, সেগুলো তারা গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়েছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মিশেলের রিপোর্টে সেটিই প্রতিফলিত হয়েছে। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলছে, মিশেলের প্রতিবেদনে আবারো প্রমাণিত হয়েছে, বিএনপি একটি মিথ্যুক দল। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বারবার মিথ্যা বলে বহির্বিশ্বে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বরং ‘গুম-খুনের’ কলঙ্কজনক তকমা থেকে মুক্ত হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নশীল দেশের রোল মডেল এখন বাংলাদেশ।
বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বাধা না দেয়া : রাজপথের বিরোধী দলকে স্বাধীনভাবে মিছিল-মিটিং সমাবেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নেত্রী বলেছেন তারা মিছিল-মিটিং-সমাবেশ করুক। তারা স্বাধীনভাবে করুক। আমাদের তরফ থেকে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই।
শুধু এটিই প্রথম নয়, এর আগেও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিরোধী দল যদি আন্দোলন করে, এমনকি আমার কার্যালয় ঘেরাও করার কর্মসূচি দেয়- আমি বাধা দেব না, তাদের নিয়ে এসে চা খাওয়াব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরোধী দলের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সহনশীল মনোভাব নতুন একটি মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। যদিও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, আন্তর্জাতিক চাপের কারণেই এখন বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। কারণ মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার চাপের মুখে রয়েছে। আর এ কারণেই হয়তো বিরোধী দলকে কিছুটা সুযোগ দিচ্ছেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তারা বলছেন, বিরোধী দলের রাজনৈতিক আন্দোলনের ব্যাপারে সরকারের ওপর কোনো চাপ নেই এবং এ ধরনের চাপ দেয়ার প্রশ্নই আসে না।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, এক সাগর রক্তবিধৌত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে চাপ অনুভব করার দল আওয়ামী লীগ নয়। আমরা আলোচনা করে, বৈঠক করে, কূটনৈতিক তৎপরতায় স্বাধীনতা লাভ করিনি। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও মহাশক্তিধর বিশ্ব মোড়লদের সঙ্গে যুদ্ধ করেই জাতির পিতার ঐতিহাসিক নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছে। সুতরাং চাপ অনুভবের কোনো কারণ নেই।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, জাতিসংঘের প্রতিনিধির বাংলাদেশ সফর ছিল রুটিন ওয়ার্ক। তবে তার পর্যবেক্ষণ এবং আমাদের বাংলাদেশ নিয়ে প্রতিবেদন শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের নয়, সেই সঙ্গে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। তিনি বলেন, এতদিন ধরে বিএনপি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। এখন ব্যাচেলেটের প্রতিবেদনে গুম-খুনের মতো বিশেষ মানবাধিকার নিয়ে সমস্যা ও উদ্বেগজনক অবস্থায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম না থাকায় এটি প্রমাণিত- বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপি যে চিৎকার করে আসছে, তা সত্যের অপলাপ।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, তারেক জিয়ার নির্দেশে মির্জা ফখরুলরা দেশে বসে মিথ্যাচার করছে, অপপ্রচার করছে; ষড়যন্ত্র করছে এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। তিনি বলেন, সদ্য বাংলাদেশ সফরকারী জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী জাতিসংঘের দৃষ্টিতে মানবাধিকার বা অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ প্রকাশিত হয়নি। যেসব দেশ ও অঞ্চলে মানবাধিকার ও মানবিক অধিকার নিয়ে সমস্যা ও উদ্বেগ রয়েছে, সেটি জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের প্রধান মিশেলের রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। সেই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ নেই। এতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, জাতিসংঘের প্রতিনিধির বাংলাদেশ সফর এবং পর্যবেক্ষণ তাদের বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনার অংশ। বাংলাদেশ নিয়ে জাতিসংঘ যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে- গুরুত্ব দিয়ে আমাদের সবার নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন। গুম-খুনের মতো বিশেষ মানবাধিকার নিয়ে সমস্যা ও উদ্বেগজনক অবস্থায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম না থাকা সরকারের জন্য যেমন স্বস্তির বিষয়, জনগণ হিসেবে আমাদের জন্যও সুখকর।
মানবাধিকার আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, সরকারের করণীয় আন্তর্জাতিক এই সংগঠনের পর্যবেক্ষণ গুরুত্ব দিয়ে দেখা।