একটুখানি সুখ আর উন্নত জীবনের আশায় চোখে স্বপ্ন নিয়ে প্রতিবছরই দেশ ছাড়ছেন লাখো মানুষ। পাড়ি জমাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তাদের প্রেরিত রেমিট্যান্সে একদিকে যেমন সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার, সচল হচ্ছে অর্থনৈতিক চাকা, তেমনি গতি বাড়ছে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এই প্রবাস গমন প্রবণতা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে বেশকিছু উদ্বেগের বিষয়, আর যার শীর্ষে রয়েছে মানব পাচার! এমনকি বর্তমান বিশ্বে যে কয়েকটি সমস্যাকে অত্যন্ত প্রকট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে মানব পাচার অন্যতম। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও মানব পাচার পরিস্থিতি খুব ভয়ানক ধারণ করেছে। ঘৃণ্য এই অপরাধের শিকার হচ্ছেন অগণিত মানুষ। মারাও যাচ্ছেন অনেকে। বেশির ভাগ সময়ে সে খবর মিডিয়া পর্যন্ত পৌঁছায় না। মিডিয়া দূরে থাক, স্বজনরাও জানতে পারেন না। স্বজন হারানোর চাপা আর্তনাদ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় তাদের।
একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিনির্ভর এই আধুনিক যুগে এসে এখনো কেন মানব পাচার ঠেকাতে এত বেগ পেতে হচ্ছে—এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরি। মানব পাচারের নেপথ্যে দুটি বিষয় সমান্তরালভাবে কাজ করে। বেকারত্ব এবং দরিদ্রতা। সমাজে বেকারত্ব বাড়লে দরিদ্রতার সৃষ্টি হয়। তখন দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি পেতে মানুষ নানা পথ খুঁজতে থাকে। সে সময় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি কর্মসংস্থানের পথ দেখায় বা ভাগ্য বদলের উপায় বাতলে দেয়, মানুষ তখন তাদের শরণাপন্ন হয়। এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে পাচারকারী সংঘ। স্বল্প খরচে প্রবাসে পৌঁছে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে দরিদ্র অসহায় মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে তাদের ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে। কারো অঙ্গহানি হচ্ছে, কেউ দাসত্বের বেড়াজালে আটকে পড়ছে, কেউ গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই মারা যাচ্ছেন। একসময়ে মানব পাচার করা হতো জোরপূর্বক। শিশু ও নারীদের জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হতো বিভিন্ন দেশে। কিন্তু এখন এ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে ভিক্টিমের সম্মতিক্রমেই। চাকরির প্রলোভন, উন্নত জীবনের স্বপ্ন, নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা বা বসবাসের ভালো পরিবেশ দেওয়ার কথা বলে একশ্রেণির মানুষ ছলচাতুরি করে পাচারের ফাঁদ পেতে বসছেন এবং ভিক্টিম স্বেচ্ছায় এসে পা দিচ্ছেন প্রতারণার সেই ফাঁদে। আবার বর্তমানে প্রতারক চক্ররা প্রযুক্তির সহযোগিতায় বুনছেন নতুন ফাঁদ। পাচার চক্রের সদস্যরা ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টিকটক, লাইকিসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় তৈরি করছে নানা গ্রুপ ও কমিউনিটি। এরপর সেখানে আয়োজন করছে টিকটক শো, লাইকি শো, পুল পার্টি। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি করে তাদের উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে দিচ্ছে বিদেশে। এসবের ফলে মানব পাচারের রশিকে টেনে ধরা দিনকে দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।
মানব পাচারের সঠিক পরিসংখ্যান বের করা কঠিন। তবে বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, গত ৩০ বছরে প্রায় ১০ লাখ মানুষ পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। যদিও মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ ও এরই ধারাবাহিকতায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২০২২-এর আওতায় দেশব্যাপী মানব পাচার দমন ও প্রতিরোধ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যা স্পষ্টতই পাচার প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। তবে যেহেতু মানব পাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা, তাই কেবল সরকারের সদিচ্ছা ও আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই সমস্যার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব নয়। কেননা যেখানে ভিক্টিম নিজেই প্রতারণার ফাঁদে এসে পা দিচ্ছে সেখানে সরকারের একার পক্ষে মাঠ পর্যায় থেকে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে মানব পাচারের বিরুদ্ধে সরব হতে হবে। প্রতারক চক্রের ফাঁদের ধরন ভিন্ন ভিন্ন হলেও সব ক্ষেত্রেই কিছু বিষয়ে সাদৃশ্যতা পাওয়া যায়। যেমন অপর্যাপ্ত বা ভুল তথ্য, নানা মিথ্যা আশ্বাস ও প্ররোচনা। এ বিষয়গুলোতে একটু সচেতন হলেই প্রতারণা ধরে ফেলা সম্ভব হবে।
মানব পাচার প্রতিরোধে একদিকে যেমন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে তেমনি পাচার হওয়ার নেপথ্যে যে নিয়ামকগুলো ভূমিকা রাখছে বিশেষ করে দরিদ্রতা ও বেকারত্ব নিরসনে ভূমিকা রাখতে হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি জোরারোপ করতে হবে। তবেই শিকড় থেকে মানব পাচার রুখে দেওয়া সম্ভব হবে।