তেভাগা থেকে টংক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি আন্দোলনে সশস্ত্র সংগ্রামে বাংলার নারীসমাজ শুধু অংশগ্রহণ করেনি, বরং সামনের কাতারে থেকে অকাতরে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। বাঙালি জাতির সহস্র বছরের ইতিহাসে নারীরা জঙ্গলের পশুদের খেদিয়ে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে নিজের এবং সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন। সংগত কারণে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, জাতিরাষ্ট্রের জন্য নারীর লড়াকু ভূমিকাকে দীর্ঘ বিস্মৃত ইতিহাস থেকে বের করে আনা, নারীর বীরত্বপূর্ণ, গৌরবময় ভূমিকাকে যথাস্থানে সম্মান দিয়ে জাতীয় ইতিহাস (নারীমুক্তি পিডিয়া) নির্মাণ করা এখন অত্যাবশ্যকীয় কাজ।
তেভাগা আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, টংক আন্দোলন সর্বোপরি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ইলা মিত্র, কল্পনা দত্ত, অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, রাশিমণি হাজং, মনোরমা বসুসহ অসংখ্য নারী সশস্ত্র সংগ্রামীদের অবদান বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের পথকে ক্রমহ্রাসমান করেছে। অমর একুশের ভাষা আন্দোলনে আমতলায় নারীরা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্তে অটল থেকে ৪র্থ লাইনে চার জন করে মিছিলে মিছিলে এগিয়ে যান। সেদিন অসংখ্য নারী পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সশস্ত্র বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন তা নয়, ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, রাজশাহী, খুলনার শহরে শহরে, এলাকায় এলাকায় নারীরা বিক্ষোভ করেন। বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ রোপিত হয়েছিল একুশের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। আর এতেই ছিল তাদের গৌরবময় সক্রিয় অংশগ্রহণ।
উনসত্তরের গণআন্দোলন ও অভ্যুত্থানে নারী ও ছাত্রীসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন আসাদুজ্জামান (আসাদ)। শোকাহত আসাদের মা শিবপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে ছাত্রনেতাদের উদ্দেশ এক বাণী পাঠালেন, ‘‘আমার আসাদের মৃত্যু হয়নি। আমার আসাদ বলত, মা আগামী ১০ বছরের এই মাতৃভূমি নতুন জীবন পাবে।’ আমার আসাদের স্বপ্ন সার্থক করো। উনসত্তরের গণআন্দোলন ও অভ্যুত্থানকালে সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় প্রায় আড়াই হাজার নারী কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সমাবেশ করেন এবং মিছিলযোগে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত যান। ২৪ মার্চ দৈনিক আজাদের তথ্যানুয়ায়ী, সেদিন বোরকা পরা হাজার হাজার পর্দানশিন নারী যোগ দেন মিছিলে।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামে নারীসমাজের রয়েছে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা। নারীসমাজ ও ছাত্রীসমাজ তাদের সর্বোচ্চ শক্তি ও সামর্থ্য প্রয়োগ করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরিতে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও আমরা সচরাচর রাজনীতিক, শিক্ষক ও ছাত্রদের বক্তৃতামঞ্চে বলতে শুনি, ৩০ লাখ শহিদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই বাক্যটি দিয়ে নারীর স্বীকৃতি আংশিক মেলে, পূর্ণাঙ্গ অবদানের কথা উল্লেখ করা হয় না। এতে সব প্রজন্মই প্রকৃত ইতিহাস, সত্য জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকালে নারী সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন, নিজে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং অন্য বোনদেরও দিয়েছেন। ক্যাম্প ও হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার, সেবিকা হিসেবে কাজ করেছেন, খাবার রান্না করেছেন, রান্না খাবার পাঠিয়েছেন, শরণার্থী শিবির ও ক্যাম্পগুলোতে গান গেয়ে মনোবল বৃদ্ধি করেছেন। এরকম বহুমাত্রিক দুঃসাহসিক কাজ নারীরা করেছেন সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীন মাতৃভূমির জন্য।
মুক্তিযুদ্ধকালে সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় মহিলা পরিষদের কর্মীরা সারা দেশে তৎপর ছিলেন। তারা বিভিন্ন কর্মসূচি ও তৎপরতার মাধ্যমে বাংলার নারী-পুরুষদের মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেন। মুমতাজ বেগম, কাজী রোকেয়া সুলতানা, বেবী মওদুদ, রানী খান, রোকেয়া কবীর, মনিরা আক্তার প্রমুখ নারী জনমত গঠনের পাশাপাশি ফিজিক্যাল ফিটনেস, মার্চপোস্ট, অস্ত্র চালনা, ফাস্ট এইড এবং আত্মরক্ষার কৌশলসহ নানা বিষয়ে পাড়ায় পাড়ায় প্রশিক্ষণ দিতেন। বদরুন্নেসা আহমেদ, বেগম নূরজাহান খুরশীদ, সাজেদা চৌধুরী, প্রীতিরানী দাশ পুরকায়স্থ নানা মাত্রিক কর্মের মাধ্যমে নারীদের সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করতেন। এই মহিলা কমিটিতে প্রীতিরানী দাস ছাড়াও গীতারাণী নাথ, নিবেদিতা দাস, সুধারাণী কর, সুষমা দাস ও রমা দাসের নাম উল্লেখযোগ্য। কাজের সুবিধার্থে প্রশিক্ষণসেবা, ধাত্রীসেবা, প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা, কুটিরশিল্প, মুদ্রণ কর্ম প্রভৃতি সাব-ইউনিটে বিভক্ত হয়ে কাজ করেছেন নারীরা।
মুক্তিযুদ্ধকালে নারীদের মধ্যে যারা যুদ্ধ যেতে চেয়েছিলেন, তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ক্যাম্পগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল গোবরা ও ল্যাম্বুছড়া ক্যাম্প। তাছাড়া ইউমেন কো-অর্ডিনেটিং কাউন্সিলের প্রশিক্ষণ, মেজর জিয়াউদ্দিন বাহিনী প্রশিক্ষণ ও মেজর জলিলের নারীবাহিনী প্রশিক্ষণ ছিল অন্যতম। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে অসংখ্য নারী সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন এবং অনেকে নেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্তও করেছেন। তাদের মধ্যে কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল ও রওশন আরা বেনীলাল দাসগুপ্ত, শোভারাণী মল, বীথিকা বিশ্বাস, মিনারা বেগম ঝুনু, গীতশ্রী চৌধুরী, আলেয়া বেগম, ফেরদৌস আরা বেগম, আশালতা বৈদ্য, জিন্নাত আরা, করুণা বেগম, মেহেরুন্নেছা মীরা উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন তিন জন বীর নারী মুক্তিসেনা। বীরপ্রতীক তারামন বিবি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কুড়িগ্রামের শঙ্কর মাধবপুর গ্রাম থেকে। তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর। যুদ্ধ করেছেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের বীর-উত্তমের নেতৃত্বে। শিরিন মিতিল যখন যুদ্ধে যান, তার বয়স ২১ বছর। এসব বীর নারী মুক্তিসেনার কেউ কেউ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে স্বামী সংসারে কিংবা নিজ বাড়িতে আশ্রয় পাননি। তন্মধ্যে বিথীকা বিশ্বাস, শিশির কণা, রমা চৌধুরীর নাম উল্লেখ করা যায়। সম্মান তো জোটেনি, উলটো তাদের ললাটে জুটেছে সামাজিক লাঞ্ছনা। এ রকম উদাহরণ অসংখ্য।
১৯৭১ সালে যুদ্ধকালে আহত যোদ্ধাদের সেবা দানের জন্য মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসক আবদুল মবিন ও ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল, যা বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতাল নামে পরিচিত। সেসময় এ হাসপাতালে ডা. আখতার ও সেতারা বেগমসহ কয়েক জন ডাক্তার থাকলেও মূল জনবল ছিল সেবিকারা। চারদিকে বাঁশের খুঁটি, মাটির ভিত, আর বাঁশের চার খুঁটির ওপর মাচা বেঁধে বিছানা নিয়ে ছিল হাসপাতালের অবকাঠামো। তবু নারীদের দেশপ্রেম, স্বল্প প্রশিক্ষণ ও নিরলস অকাতর সেবায় আহত মুক্তিযোদ্ধারা সুস্থ হয়ে ওঠেন, একজন যোদ্ধাও মৃত্যুবরণ করেননি। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে মুজিব নগর সরকার একটি নার্সিং প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুললে সেখানে দুই ব্যাচে ৩২ জন নারী প্রশিক্ষণ নেন। তাদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও যুদ্ধক্ষেত্রে সেবার জন্য পাঠানো হয়। ২ নম্বর সেক্টরেও বাংলাদেশ সরকারের একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ হাসপাতালেও বহু সেবিকা দিবারাত্রি আহত যোদ্ধাদের সেবা করতেন।
ছায়ানট সভাপতি কবি সুফিয়া কামাল কলকাতায় বসে নারী গায়ক দল পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প, শরণার্থী শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করতেন। একথা কয়জনই-বা জানে। নাজিয়া ওসমান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। সেলিনা বানু সশরীরে উপস্থিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা, শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে তৎপর ছিলেন। এসব কাজে বেগম মুস্তারী শফি, মতিয়া চৌধুরী, মালেকা বেগম, আয়েশা খানমের নাম উল্লেখযোগ্য। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গঠনে এবং গীত রচনায় ও সংগীত পরিবেশনায় নারীদের অবদান অনস্বীকার্য।
শাহনাজ রহমতুল্লাহর কণ্ঠে—‘সোনা সোনা সোনা, লোকে বলে সোনা, সোনা নয় তত খাঁটি’ আর কল্যাণী ঘোষের কণ্ঠে—‘পূর্ব দিগন্তে জোয়ার উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল’—এ রকম অসংখ্য গান গেয়ে শিল্পীরা বাংলার মুক্তিপাগল জনতাকে উজ্জীবিত ও উদ্বুদ্ধ করতেন। এরকম অজস্র গান শুনে মানুষ শিহরিত হয়েছে এবং ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশরক্ষার সংগ্রামে।
স্বাধীন বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের প্রতিটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন বাংলার নারীদের অংশগ্রহণ ছিল গৌরবময়, বীরত্বপূর্ণ। তাই সহস্র বছরের বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের গৌরবময় ভূমিকার কথা কেবল স্মরণসভা, পুস্তক প্রকাশনা, বিভিন্ন নামকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধতা না রেখে জাতীয় ইতিহাস নির্মাণে, পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তকরণসহ অসংখ্য কাজ করবার রয়েছে। এতে করে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারীদের ভূমিকাকে বিস্মৃতির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে, অন্যদিকে আগামী প্রজন্ম তাদের আত্মত্যাগকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে, জানবে।