গেল ১৯ এপ্রিল ২০২৫ শনিবার দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে মুক্ত আর্টেসের আয়োজনে লন্ডনের টেমস নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সিলেট অঞ্চলের ‘’লোকজ ঐতিহ্য ধামাইল উৎসব’’।
বাংলা হ্যারিটেজ ফ্যাস্টিভ্যালে ব্রিটিশ বাঙ্গালীরা ফিরে দেখলেন বিলুপ্ত প্রায় সেই ‘’ধামাইল গীত নৃত্য’’। সিলেটের কৃতি সন্তান মরমী সাধক রাধা রমন দত্ত এর প্রবর্তক। রাধা রমন দত্ত নিজে লিখেছেন শত শত মরমী গান, নিজে গেয়েছেন সুরও করেছেন। সিলেট অঞ্চলের মানুষের কাছে এটি ধামাইল গান হিসেবে পরিচিত।
এক সময় সিলেট অঞ্চলের হিন্দু মুসলিম নারীরা একত্রিত হয়ে নৃত্যের তালে তালে এই সঙ্গীত পরিবেশন করতেন এটি বাংলার লোকজ সহিত্যে ধামাইল গান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। রাধা রমন দত্ত রচিত প্রতিটি গানের একটি আলাদা বৈশিষ্ট রয়েছে, তাঁর প্রতিটি গানের শেষে অথবা প্রথমে রয়েছে ভাইবে রাধা রমন বলে। আজ সিলেট অঞ্চলের মানুষজন বিভিন্ন ভাবে তাঁর গানের এই উক্তিটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন ‘‘ভাইবে রাধা রমন বলেরে।’’
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মুক্ত আর্টসের সভাপতি সংস্কৃতিজন সত্যব্রত দাস স্বপন। এর পর মুক্ত আর্টসের বিগত দিনের কার্যক্রম ও চলতি বছরের হ্যারিটেজ ফ্যাস্টিভ্যালের বিবরণ তুলে ধরেন সংগঠনের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ড. অসীম চক্রবর্তি।
অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ’’ বরাক উপত্যকার সমাজ পরিবর্তন ও নারী স্বাধীনতা নৃত্যগীতের ভূমিকা শীর্ষক আলোচনা। আলোচনায় অংশ নেন কার্ডিফ সিটি কাউন্সিলের কাউন্সিলার জেসমিন চৌধুরী, লেখক সাংবাদিক আলবাব, মাইক্রসফ্টের মার্কেটিং ডিরেক্টর ও ব্রিটেনে ব্রিটিশ বাঙ্গালীর প্রথম প্রজন্মের প্রতিনিধি সুপ্রিয়া দেব পুরকাস্থ। আলোচকরা তুলে ধরেন ধামাইলের অন্তর নিহিত শক্তি এবং সমাজ গঠনের ভূমিকা।
এর পর শিশু শিল্পীদের পরিবেশনা ধামাই গাল পুরো হলজুড়ে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। এতে ধামাইল গীত পরিবেশন করেন স্নিগ্ধা রায়, রূপক দত্ত, বিন্থি দাস বৃন্দা দাস ও ঈসা দাস। ধামাইল নৃত্য পরিবেশন করেন বিরোজা দে, শ্রিয়া গৈাস্বামী, আরুষী চক্রবর্তি, শতাক্ষী দেব, রুদ্রনীল দেব ও আনুষা দাস। ব্রিটেনে জন্ম নেয়া এসব শিশুদের প্রধান ভাষা ইংরেজী হলেও তাদের কণ্ঠে ও নৃত্যে ধামাইলের শুদ্ধতা ছিল ছোঁখে পড়ার মতো। এর পর সুরালয়ের শিল্পিদের সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয় দুটো ধামাইল গীতনৃত্য এতে অংশ নেন রঞ্জিতা সেন, জয়শ্রী পুর্কাস্থ, প্রিয়াংকা ঘোষ, অল্পনা পাল, সুপিয়া দেব পুর্কাস্থ এবং শুভাঙ্গী দাম।
ধামাইলের বিশেষ পরিবেশনা পর্বে অনুষ্ঠিত হয় গল্প ভিত্তিক গীতি আলেখ্য ‘’ধামাইল কথা’’ রচনা ও নির্দেশনায় ড. অসীম চক্রবর্তি, পল্পসূত্রধর প্রদীপ রায়ের কণ্ঠে ধামাইলের বিভিন্ন পর্বের গল্প। এতে উঠে আসে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের কবি চন্ডি দাস ধামাইলের কিংবদন্তি শ্রী রাধা রমন দত্ত। প্রতাপ রঞ্জন নীরের কিংবা ওস্তাত বড়ে গোলাম আলী বেনারস ঘরনার ঠুমরি।
অমিত দের কণ্ঠে বন্দনা সঙ্গীত ‘’প্রথম বন্ধনা করি জয় জয় কিশোরীর’’ গৌরী চৌধুরীর কণ্ঠে ‘’ বাঁশিরে পরানের বাঁশি।
বাংলা হ্যারিটেজের সভাপতি সত্যব্রত দাস স্বপন বলেন এটি আমাদের তৃতীয় ফ্যাষ্টিভ্যাল এর আগের দুটি উৎসবে আমরা ভাঠিয়ালী ও বাংলা কৃর্তন উদযাপন করেছি। এবারের মূলপ্রতিপাদ্য ধামাইল সঙ্গীত ও নৃত্য। এবছর মুক্ত আর্টস তৈরী করেছে ১৫টি ভিডিও চিত্র, এতে উঠে এসেছে ধামাইলের ইতিহাস, বিকাশ পরিবেশন রীতি ও স্মৃতিচারণ। চিত্র শিল্পি মৌনিমুক্তা চক্রবর্তির তিনটি চিত্র কর্মের উপর তৈরী হবে একটি তথ্যচিত্র। যা সঙ্গীত ও গল্পের মাধ্যমে ধামাইলকে তুলে ধরা হবে। এতে লিখছেন বাংলা ও ইংরেজীতে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের খ্যাতিমান ফোকলোর গবেষকরা। ব্রিটিশ লটারী হ্যারিটেজ ফান্ডের সহযোগীতায় এসব কর্মযজ্ঞের প্রতিটি মূহুর্থ সংরক্ষিত থাকবে টাওয়ার হ্যামলেটস হিষ্ট্রি আরকাইভ মিউজিয়ামে। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধামাইল সম্পর্কে জানতে পারে। এটি সংরক্ষিত হবে আইডিয়া ষ্টোর লাইব্রেরীতে।