এবারের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হলো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। আর এই কারণে ব্যাংক সুদের হারের ওপর থেকে ক্যাপ (সীমা) তুলে দেয়া হয়েছে। আর ডলারের দামও বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে। তবে অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশ্লেষকেরা মনে করেন এতে মূল্যস্ফীতির ওপর তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বেনা। কিন্তু সুদের হার বাড়লে তাতে ছোট ঋণ গ্রহীতারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যারা বড় আকারে ঋণ নেন তাদের কোনো সমস্যা হবেনা। এটা নিয়ে মুদ্রা ব্যবস্থার সার্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবেনা।
এই মুদ্রানীতি ছয় মাসের জন্য। রোববারে ঘোষণা করা মুদ্রানীতি জুলাই থেকে কার্যকর হবে। আগামী মাস থেকে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে নতুন পদ্ধতি চালু হবে। তাতে সুদের হার ১০-১১ শতাংশ হওয়ার কথা। আর আমানতের সুদের হার শতকরা সাত টাকা থেকে বেড়ে ৮-৯ শতাংশ হতে পারে।
যে পদ্ধতিতে সুদের হার নির্ধারণ হবে
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার নতুন সুদের হার নির্ধারণের পদ্ধতিকে ‘শর্ট টার্ম মুভিং অ্যাভারেজ রেট’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুদের হার নির্ধারণ করা হবে ১৮২ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদের সঙ্গে সর্বোচ্চ তিন শতাংশ যোগ করে। আর সিএমএসএমই (কটেজ, মাইক্রো, স্মল, মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ) এবং ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে যোগ করতে পারবে চার শতাংশ। বর্তমানে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার সাত শতাংশের নিচে। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ট্রেজারি বিলের গড় সুদের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ যোগ করতে পারবে।
বাজেটে (২০২৩-২৪) সরকার মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশ এবং সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবার প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিয়েছে। গত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ১৪.১০ শতাংশ ঋণ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়। আর আগামী ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ ১০.৯ শতাংশ এবং অর্থবছর শেষে ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য দেয়া হয়েছে। সরকারি খাতে ডিসেম্বরে ৪৩ শতাংশ এবং আগামী জুনে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা আগামী ডিসেম্বরে সাড়ে ৯ এবং জুনে ১০ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মে মাসে সরকারি হিসেবে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৯.৯৪ শতাংশ। যা গত ১১ বছরে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সাধারণ নিয়মে হয়নি
সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘‘চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে অথবা সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখন যে মূল্যস্ফীতি তা সেই নিয়ম মেনে হয়নি। ডলার সংকট এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এটা হয়েছে। আর দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও তার প্রভাব এখানে পড়ে না। চাহিদা বাড়ার কারণে দাম বাড়লে টাকা সরবরাহ কমিয়ে দিলে দাম কমে। কিন্তু এখানে চাহিদা যে বেড়ে গেছে তা কিন্তু নয়।’’
তার কথা, ‘‘সুদের হার বাড়লে টাকার সরবরাহ কমে। এখন সেটা যদি ব্যাপক ভাবে করা হয় আর সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে ধার করে তাহলে ব্যক্তি খাত টাকা পাবে কোথায়? তাই বাস্তবে এই চিন্তা কোনো কার্যকর ফল বয়ে আনে না।’’
তিনি মনে করেন, ‘‘এভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। মূল্যস্ফীতির পিছনে অনেক কারণ আছে। এটা রাতারাতি কিছু করা সম্ভব নয়। সুদ বাড়িয়ে সেটা করতে হলে আর সব কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। সেটা করলে আবার প্রবৃদ্ধি নিয়ে সমস্যা হবে।’’
ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অর্থনীতি অনেক দিন ধরেই ভুল নীতির ওপর চলছে। এখন ডলারের তিন ধরনের রেট আছে। এটা বাজারের হাতে ছেড়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে তা নয়। আমাদের তো ডলার ক্রাইসিস আছে। সেটা আগে সামাল দেয়ার পথ বের করতে হবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘সরকারের ওপর তো আরো চাপ বাড়বে। ২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আমরা ৫৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশ থেকে ঋণ নিয়েছি। এর ভিতরে ১৭-১৮ বিলিয়ন ডলার আছে শর্ট টার্ম লোন। এক সময় তো ভালো লেগেছে। আমাদের রিজার্ভ বেড়েছে। এখন তো ফেরত দিতে হবে। এখন কী হবে?’’
সব হচ্ছে আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে
আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আইএমএফ বলেছে তাই বাংলাদেশ বলল সুদের সীমা তুলে দিলাম। কিন্তু এটা তো আর বাস্তবে বাজার ভিত্তিক হয় নাই। উন্নত বিশ্বে সুদের হার দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু আমাদের দেশে তো সেরকম নয়। এখানে সুদের হারের সাথে মূল্যস্ফীতি তেমন রেসপন্স করেনা। হয়তো সামান্য প্রভাব পড়তে পারে।’’
তার কথা, ‘‘বাংলাদেশের ৬০ ভাগ মানুষ তো ব্যাংক ঋণের মধ্যে নাই। ৪০ ভাগ লোক আছে আর মধ্যে বড় একটি অংশ মাইক্রো ফাইনান্স নেয়। এই সুদের হার বাড়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যারা বড় আকারের ঋণ নেয় তারা লাভবান হবে। কারণ তারা ব্যাংকে সঙ্গে কথা বলে কমেও ঋণ নিতে পারবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘ব্যক্তি খাতে ঋণ কমিয়ে দেবে। সেটা হলে কর্মসংস্থান কীভাবে হবে। বাংলাদেশে ব্যক্তিখাতেই কর্মসংস্থান বেশি হয়। সরকার ঋণ নিয়ে কী করবে? বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এসএমই খাতে ঋণ দরকার। সেখানে কমে গেলেও অনেক উদ্যোক্তা কমে যাবে।’’
তিনি মনে করেন, ‘‘ডলার ও রিজার্ভ সংকট কাটাতে হলে রেমিটেন্স আরো সহজ করতে হবে, রপ্তানি বাড়ানোর উপায় খুঁজতে হবে। এফডিআই বাড়াতে হবে। ঋণ প্রবাহ বাড়াতে হবে। ডলার রেট বাজারের হাতে ছেড়ে দিলেই সমাধান হয়ে যাবেনা।’’
তার অভিমত, ‘‘এখন যা করা হচ্ছে তা আইএমএফের প্রেসক্রিপশন। তাদের ওই একই কথা, বলে সুদের হার বাড়াও, ডলার বাজারের ওপর ছেড়ে দাও। এই প্রেসক্রিপশন দিয়ে তো সব হবে না।’’
আইএমএফের প্রেকক্রিপশনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর রোববার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ আইএমএফের সদস্য। সদস্য দেশকে তারা বিভিন্ন পরামর্শ দেয়। আমরা কখনো মানি, কখনো মানি না। বর্তমানে বিদেশি ঋণের সুদহার আট থেকে ৯ শতাংশ। আইএমএফ দুই শতাংশের কম সুদে ঋণ দিচ্ছে। সস্তা ঋণ নিতে হলে তো কিছু কথা শুনতে হয়।’’