ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যসহ জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেলেও সম্প্রতি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ দেশের মুদ্রামান কমে যাওয়ায় এর সুফল মিলেনি। ডলারের বিপরীতে তেলের দাম গত ফেব্রুয়ারিতে ৬ শতাংশ কমেছে।
তবে এই সময়ে প্রায় উন্নয়নশীল দেশের মুদ্রা মান কমে যাওয়ায় তেল আমদানিকারী ৬০ শতাংশ দেশে দাম বেড়েছে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন খাদ্য ও জ্বালানির সংকটকে তীব্র করেছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক। গতকাল ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কা করা হয়েছে। নিত্যপণ্যের বাজার দর বিশ্লেষণ করে প্রতি বছর এপ্রিলে এবং অক্টোবরে পূর্বাভাস প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর গত ফেব্রুয়ারির পর থেকে জ্বালানির দাম বাড়তে থাকে। বর্তমানে ডলারের হিসাবে জ্বালানির দাম ৬ শতাংশ কমেছে। কিন্তু এরপরও তেল আমদানিকারী ৬০ শতাংশ দেশের খরচ বেড়েছে শুধু অর্থের অবমূল্যায়নের কারণে। এই একই কারণে ৯০ শতাংশ দেশে গমের দাম বেড়েছে।
জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষি উত্পাদন ব্যয়ও বেড়েছে। ২০২২ সালের প্রথম ত্রৈমাসিক (জানুয়ারি-মার্চ) হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্যপণ্যের মুল্যস্ফীতির হার গড়ে ২০ শতাংশের বেশি ছিল। লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা, সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়াসহ অন্যান্য অঞ্চলে খাদ্যমূল্যস্ফীতি গড়ে ১২ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে পাওয়াগেছে। তবে পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরই একমাত্র অঞ্চল, যেখানে খাদ্য-মূল্যের মূল্যস্ফীতি কম, আংশিকভাবে চালের দাম স্থিতিশীল থাকার কারণে এই অঞ্চলের খাদ্যমূল্যস্ফীতি তুলনামূলক কম ছিল।
বিশ্বব্যাংকের ইক্যুয়েটেবল গ্রোথ, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনস্টিটিউশন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট পাবলো সাভেদ্রা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, যদিও সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যের দাম কিছুটা কমেছে। এর পরেও এখনকার দাম গত পাঁচ বছরের গড়ের চেয়ে বেশি রয়েছে। খাদ্যের দাম বাড়লে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্যনিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ আরো দীর্ঘায়িত হবে। নীতিনির্ধারকদের খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখা এবং সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় বাড়াতে উদ্যোগী হওয়ার সুপারিশ করেছেন তিনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। ২০২২ সালে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির পর ২০২৩ সালে ১১ শতাংশ কমে আসার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এর পরেও গত পাঁচ বছরের গড় দামের চেয়ে বিশ্ববাজারে ৭৫ শতাংশ বেশি থাকবে জ্বালানির দাম। সবমিলিয়ে ২০২৩ সালে গড়ে ৯২ ডলার থাকতে পারে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম। গত পাঁচ বছরে অপরিশোধিত জ্বালানির গড় মূল্য ছিল মাত্র ৬০ ডলার। আগামী বছর প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার দাম কিছুটা কমে আসবে। এর পরেও অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগের পাঁচ বছরের গড় দামের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ থাকবে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম। এই দাম ইউরোপে চার গুণ বেশি। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ব জুড়ে কয়লার উত্পাদন বাড়বে। এর ফলে জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলার লক্ষ্যগুলো ঝুঁকিতে থাকবে।
আগামী বছর কৃষিপণ্যের দাম ৫ শতাংশ কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২২ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে গমের দাম প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে তবে এক বছর আগের তুলনায় এখনো ২৪ শতাংশ বেশি রয়েছে। বৈশ্বিক গমের উত্পাদন, চালের বাজারে স্থিতিশীল সরবরাহ এবং ইউক্রেন থেকে শস্য রপ্তানি শুরু হওয়ায় এই দাম কিছুটা কমে আসবে। ২০২৩ সালে ধাতব পণ্যের দাম ১৫ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে অনুমান করা হয়েছে, মূলত দুর্বল বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি এবং চীনে মন্দার বিষয়ে উদ্বেগের কারণে ধাতব পণ্যের চাহিদা কমে আসবে বলে ধরণা করা হচ্ছে। ইউরোপে আসন্ন শীতকালে জ্বালানির প্রাপ্যতা নিয়ে উদ্বেগ আরো তীব্র হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। আগামী বছর সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দা সম্পর্কে উদ্বেগ ইতিমধ্যেই তামা এবং অ্যালুমিনিয়ামের দাম কমিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রসপেক্টস গ্রুপের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ জন ব্যাফেস এ বিষয়ে উল্লেখ করেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ রপ্তানি ব্যাঘাত করলে বিশ্বব্যাপী শস্য সরবরাহ কমে যেতে পারে। তাছাড়া প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফলনও কমতে পারে। বিশেষ করে ২০২৩ সালে এলনিনোর প্রভাবে দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোর ফলন হ্রাস করতে পারে।