চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সংকটে ডলারের বাজার। আমদানি ও স্থানীয় পণ্যের ওপরেও পড়েছে এর প্রভাব। ফলে দেশে এখন মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের (জানুয়ারি-জুন) সময়ের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক এবার থেকে বছরে দুই বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ১৫ জানুয়ারি নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে। আর এই মুদ্রানীতি হবে বর্তমান গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের প্রথম ঘোষিত মুদ্রানীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, আগামী মুদ্রানীতিতে অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি পথরেখা তুলে ধরা হবে। ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতিবিদসহ সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে সুদ হার ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে অনেকের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলেও দেশের মূল্যস্ফীতির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, সুদের হার পুনর্নির্ধারণ করা হলে অর্থনীতিতে এর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা বিশেষভাবে বিবেচনায় আনা হচ্ছে। পাশাপাশি শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত ইসলামি ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের আমানতের অবস্থা, ডলারের একক রেট চালু করা, খেলাপি ঋণ কমানো, পণ্য আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে পাচার বন্ধ করার বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো আগামী মুদ্রানীতিতে প্রতিফলিত হতে পারে। একই সঙ্গে পদক্ষেপগুলো নির্ণয় করা হবে। আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী সুদের হারের সীমা তুলে দেওয়ার বিষয়টি এখন বিবেচনায় নাও আসতে পারে। বর্তমান গভর্নরের জন্য প্রথম নতুন মুদ্রানীতিতে একটু ব্যতিক্রম হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। অর্থ বিভাগের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি মুদ্রানীতির খোলনলচে পরিবর্তন করতে চান। যেন সবার জন্য নতুন মুদ্রানীতি সহায়ক হয়।
২০০৬ সাল থেকে বছরে দুই বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছিল। ২০১৯ সাল থেকে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী সেই বছর থেকে একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময়ে একবার করে মুদ্রানীতি ঘোষণা হয়ে আসছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আইএমএফের প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করেন। সফরকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক বছরে চার বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার পরামর্শ দেন। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক বছরে দুই বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ১৫ জানুয়ারি মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। এবারও অর্থবছরের শুরুর মতো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। সর্বশেষ গত ৩০ জুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, এ মুদ্রানীতি প্রণয়নের জন্য এরই মধ্যে দেশের অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এরই মধ্যে কয়েকটি বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ৭ জানুয়ারি অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আবারও বৈঠক করা হবে। এসব বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসা মতামতের ভিত্তিতেই মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হবে।
এর আগে, গত ৫ ডিসেম্বর মুদ্রানীতি বিষয়ে দেশের অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠকে সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। মুদ্রানীতির ধরন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো পর্যন্ত সরাসরি কিছু না বললেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থনীতিবিদরাও সেই পরামর্শই দিয়েছেন।
মুদ্রানীতি প্রণয়ন প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের অর্থনীতির জন্য মুদ্রানীতির গুরুত্ব অপরিসীম। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক আবার বছরে দুই বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাস্তবসম্মত মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হলে দেশের অর্থনীতি বেগবান হবে। এজন্য অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর ওপর ভিত্তি করেই মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে হবে। তিনি বলেন, এবারের মুদ্রানীতি একটু সংকোচনই রাখতে হবে। বর্তমানে যে সংকুচিত অবস্থায় আছে, সেটাকেই ধরে রাখতে হবে, যাতে মূল্যস্ফীতি কমে আসে। সুদহার বেঁধে রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক জোর করে সুদহার বেঁধে রেখেছে। এটার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে মানায় না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকটের চাপ, বিদেশি মুদ্রার সরবরাহে টান, টাকার মান কমে যাওয়া, মূল্যস্ফীতি আর চলতি হিসাবে ঘাটতি বয়ে বেড়ানোর মতো অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক বছরের মুদ্রানীতির আগের সিদ্ধান্তে বদল আনতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রানীতির ধরন কেমন হতে পারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, জানুয়ারিতে ঘোষণার সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখন পরামর্শের জন্য অর্থনীতিবিদদের মতামত নেওয়া হচ্ছে।
সরকার বাজেটে যে নীতি ও উন্নয়ন কর্মসূচি ঠিক করে, তা বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক আর্থিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে অর্থের প্রবাহ ঠিক রাখাই মুদ্রানীতির লক্ষ্য। এমনভাবে এই নীতি সাজানো হয়, যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হয়।
পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, ‘বাস্তবসম্মত মুদ্রানীতি প্রণীত হলে দেশের অর্থনীতি বেগবান হবে। এজন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকের চিত্রের বিষয়ে গভর্নরকে অবহিত করা হয়েছে। আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলেছি।’
সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ভঙ্গি অনুসরণ ও কিছুটা সংকোচনমুখী ঠিক করে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। সেখানে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ জোগানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। তাতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ, যা এর আগের বার ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, যা আগের বার ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৮ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। জাতীয় বাজেটে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে ধরে রাখার পরিকল্পনার নির্ধারণ করে সরকার।