ব্যাপক হারে বরাদ্দ বাড়ছে ভর্তুকি খাতে
কোভিড-১৯ মহামারির কালো ছায়া না কাটতেই অর্থনীতিকে নতুন করে ঝুঁকির মুখে ফেলছে বৈশ্বিক সংকট। এতে মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে নিু ও মধ্যম আয়ের মানুষ। তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। নতুন করে দরিদ্র হয়েছে অনেকে। সরকারি হিসাবে এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি এর হার আরও বেশি।
এ পরিস্থিতিতে ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি রাখার প্রত্যাশা নিয়ে চূড়ান্ত করা হয়েছে আগামী (২০২২-২৩) অর্থবছরের বাজেট। নিয়ন্ত্রণমূলক মূল্যস্ফীতির জন্য বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি বাড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে আসন্ন বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ব্যাপক হারে।
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বৃহস্পতিবার একাদশ জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবার নতুন বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়ন করতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি বাজেট (অনুদানসহ) হবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে তিনি চাপবোধ করছেন। তবে সবশ্রেণির মানুষ যাতে উপকৃত হন এভাবে তিনি বাজেট প্রণয়ন করছেন। ছোট-মাঝারি ও বড় শিল্প উদ্যোক্তারা সবাই উপকৃত হবেন। সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে এমন কিছু তিনি বাজেটে চাপিয়ে দেবেন না বলে আশ্বস্ত করেছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বাজেটে প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এজন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতের কর্মসূচিগুলোর বরাদ্দ ও কভারেজ দুটোই বাড়াতে হবে। খুব সংকটকালে আসছে এই বাজেট। কোভিডে অনেক মানুষের চাকরি চলে গেছে, অনেকে অনানুষ্ঠানিক কাজের সুযোগও হারিয়েছে, আয় কমে গেছে অনেকের। এর ওপর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যসহ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এজন্য বিদেশি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশের ভেতরেই বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উৎসাহিত করার মতো বাজেটে উদ্যোগ থাকতে হবে।
আসন্ন বাজেট বর্তমান সরকারের সময়ে একটি পূর্ণাঙ্গ শেষ বাজেট। ফলে ব্যাপক কর্মসৃজনের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এজন্য ধরা হয়েছে বিনিয়োগের বড় লক্ষ্যমাত্রা। নতুন জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগ ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
সংকটের কারণে আগামী বছর রাজস্ব আহরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্টরা। ব্যয় মেটাতে নতুন বছরে কর আদায় করতে হবে ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর কর থেকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে আদায়ের লক্ষ্য ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া কর ছাড়া রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এ বছর বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা করা হচ্ছে ৩২৭১ কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদান পরিশোধ করতে হয় না। এজন্য এটি সরকারের আয় মনে করা হয়। এনবিআর সূত্র জানায়, রাজস্ব আহরণের জন্য নতুন করে করের বোঝা জনগণের ওপর চাপানো হবে না। এক্ষেত্রে কর আহরণের নতুন নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধান করা হবে। করের আওতা বাড়িয়ে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হবে।
এ বছর সরকারের পরিচালনা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এর বড় অংশ ব্যয় হবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে। এ খাতে যাবে ৭৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা আছে। যে কারণে আগামী বছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ খাতে ব্যয় হবে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। যেহেতু আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটছে। সে জন্য আমদানিকৃত পণ্যে বেশি করে ভর্তুকি দেওয়া হবে। বিশেষ করে সার, খাদ্যপণ্য, বিদ্যুৎ, রফতানি পণ্য ও রেমিট্যান্সসহ অন্যান্য খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনায় ব্যয় করা হবে প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে মূলধনীয় ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা।
গত দুবছর করোনার কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থমকে ছিল। উন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট করে স্বাস্থ্য খাতের অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়। তবে এখন কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল হচ্ছে। এ জন্য সরকার আগামী বছর উন্নয়ন খাতে ব্যয় বেশি করার পরিকল্পনা নিয়েছে। নতুন বাজেটে উন্নয়ন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পে ৭ হাজার ৭২১ কোটি টাকা এবং কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে ব্যয় করা হবে ২ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য আগামী অর্থবছরের এডিপিতে কাটছাঁট করা হবে না। কৃচ্ছ সাধনের লক্ষ্যে এডিবির অর্থ খরচের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে না। কারণ এডিপির প্রবৃদ্ধি না হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। এটি না হলে মানুষের আয় বাড়বে না। প্রসঙ্গত, করোনাকালীন এডিপির ২৫ শতাংশ ব্যয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল অর্থ বিভাগ। অর্থ সাশ্রয় করে স্বাস্থ্য খাতে স্থানান্তরের জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এদিকে জিডিপি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে আগামী বাজেটে ঘাটতি (অনুদানসহ) হবে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রীর কাছে বড় অঙ্কের ঘাটতি পূরণ করাই চ্যালেঞ্জ হবে। এই ঘাটতি মেটাতে তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের তুলনায় ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নেওয়া হবে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ৮৭ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র থেকে লক্ষ্যমাত্রার বেশি নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হবে ৯৫ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, করোনার মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অর্থনীতি কিছুটা সঙ্কুচিত ছিল। এরপর এখন চাঙ্গা হচ্ছে। যে কারণে চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে এমন আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। এই প্রবৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে তিনি আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ অর্জনের প্রত্যাশা করছেন।
তবে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার মূল নিয়ামক। প্রবৃদ্ধি না হলে অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসবে। শুরু হবে জনদুর্ভোগ। এমনটি বলেছেন সাবেক অর্থ সচিব (সিনিয়র) মাহবুব আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এটাও মনে রাখতে হবে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির মূল সুবিধা পায় ধনী ব্যক্তিরা। গরিব জনগণ ‘চুইয়ে পড়া’র (trickle down effect) মাধ্যমে কিছুটা সুবিধা পায়।
আসন্ন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির হারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার সময় মনে রাখতে হবে- প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হলো নাকি ৭ শতাংশ তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাথাব্যথা নেই। দ্রব্যমূল্য নিয়েই তারা বেশি মাত্রায় উদ্বিগ্ন। এছাড়া অধিক মাত্রার মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্য ও বৈষম্য বৃদ্ধি করবে। তাই ভারসাম্য রক্ষার সময় এ বছর মূল্যস্ফীতিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।