ফকির লালনকে কেউ কেউ ‘বিনয়ের অবতার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিনয় ছিল তার ভূষণ। লালন দর্শনের অন্যতম দিক হচ্ছে বিনয় ও সরলতা। এখানে গরলতা, অস্বচ্ছতা, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, হঠকারিতা, অহংকার ও অহংবোধের কোনো স্থান নেই। লালনের মতে, বিনয় দ্বারা জগেক বশীভূত করা যায়। শুধু মানুষ কেন, পশু-পাখিকেও বিনয় দ্বারা জয় করা যায়। লালন বিনয় দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। বিনয় প্রকাশ করতে তিনি তার অনেক গানের ভণিতায় নিজেকে অধীন, অধম, অবুঝ, অবোধ, অভাগা, দাস, দীন, হীন, কানা, মদন কানা, পাগলপারা, ভেড়ো, ফকির, বোকা হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এগুলো তার বিনয়, মহত্তের পরিচয়। তাই তো লালনের গানে পাই—
আমি দাসের দাস তার দাস যোগ্য নই
কোন ভাগ্যেতে এলাম এই সাধুর সাধসভায়।
লালন কয় মোর ভক্তিহীন অন্তর
এবার বুঝি পেলাম কদাচারে
আর কি বসবো এমন সাধুর সাধবাজারে।
কোনো এক সাধুসভায় লালন উপস্থিত হন। সেখানে তিনি হচ্ছেন শিরোমণি। তার পরও তিনি ঐ সভার মানুষকে সম্মান জানাতে নিজেকে শুধু দাসই নয়, দাসের অধম হিসেবে তুলে ধরেন। মানুষকে বড় করতে নিজেকে ছোট করা হচ্ছে মহত্ত্বের পরিচয়। সেটাই লালন করতেন। বলছেন, সাধুসভায় যাওয়ার যোগ্যতা তার নেই, হয়তো ভাগ্যগুণে তিনি তথায় গিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, এমন সাধুর সভা যদি আবার বসত, তাহলে তিনি তার কদাচার, অন্তরের ভক্তিহীনতা দূর করতে পারতেন। এ সবই তার বিনয়। বলেছেন—
আমি বিদ্যে বুদ্ধিহানি
ভজন সাধন নাহি জানি
বলবো কী তার রূপ বাখানি
মন মোহিনীর মনোকল্পে।
সক্রেটিস বলতেন, ‘I know only one thing that I know nothing।’ তেমনি লালন নিজেকে জ্ঞানহীন বুদ্ধিহীন হিসেবে তুলে ধরেছেন। হিন্দু পুরান অনুসারে, মোহিনী হলো পরমাসুন্দরী নারী। সমুদ্র মন্থনের পর নারায়ণ মোহিনী রূপ ধারণ করে অসুরদের অমৃত থেকে বঞ্চিত করেন। লালন মনে মনে সে নারায়ণরূপী মোহিনীর কল্পনা করেন। কিন্তু তার দর্শন পান না। তাই তিনি নিজেকে বিদ্যাবুদ্ধিহীন অভিহিত করে বিনয়ের সঙ্গে অজ্ঞতা প্রকাশ করেন—
ফোরকানের দরজা ভারি
কিসে হলো বুঝতে নারি
অবোধ লালন তাই না বুঝে
বিচারে গোল বাঁধাইয়েছে।
ফোরকান মানে কোরআন। ফোরকানের আগেও নবি ছিল, কিতাব ছিল, রোজা, নামাজ, হজ, জাকাত ছিল। মৌলিক নতুন কী এলো? আসলে সবই ধারাবাহিকতা ও নতুন সংস্করণমাত্র। লালন এই কঠিন প্রশ্নটা করেছেন অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে, নিজেকে অবোধ বলে অভিহিত করে।
কেউ বলে মুর্শিদের ঠাঁই
খুঁজিলে পাই মূল ঠিকানা
লালন ভেড়ো তাই না বুঝে হয় দোটানা।
কেউ বলে মক্কায় গেলে যাবে গুনাহ, কেউ বলে নামাজ পড়লে বেহেশত মেলে। যদিও দুটোই ঠিক। কেউ বলে মুর্শিদ তথা গুরুর মাধ্যমে মেলে স্রষ্টার সন্ধান। লালন ভেড়ো তাই না বুঝে পড়ে যান দোটানায়। ভেড়া খায় আর বেঁচে থাকে। স্রষ্টা, সৃষ্টি, বিশ্ব নিয়ে তার ভাবনা নেই। লালন তেমনি বিনয় প্রকাশ করতে নিজেকে ভেড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এখানে ভেড়ো মানে অধম।
জগৎ শক্তিতে ভুলালে সাঁই
ভক্তি দাও যাতে সে চরণ পাই।
চরণের যোগ্য মন নয়, তথাপি মন ঐ চরণ চায়
অধীন লালন বলে হে দয়াময় দয়া করো আজ আমায়।
লালন দর্শন বিনয়ে ভরা। লালন শক্তি নয়, প্রেম ভক্তি দ্বারা সবকিছু জয় করতে চান
পণ্ডিত কানা অহংকারে সাধু কানা অনবিচারে
মাতবর কানা চোগলখোরে আন্দাজি এক খুঁটি গাড়ে
জানে না সীমানা কার।
কানায় কানায় উলামিলা বোবাতে খায় রসগোল্লা
লালন তেমনি মদনা কানা ঘুমের ঘোরে দেয় বাহার।
গাছ ফলবতী হলে যেমন নুইয়ে পড়ে, তদ্রূপ মানুষ জ্ঞানী হলে জ্ঞানের ভারে সেও নুইয়ে পড়ে। অহংকার তার কাছ থেকে বিদায় নেয়। বৃক্ষ ফলহীন হলে টনটনে খাড়া থাকে। মানুষও জ্ঞানহীন হলে তার মধ্যে অহংকার বাসা বাঁধে। পণ্ডিত অহংকারী হলে তার পাণ্ডিত্য অর্থহীন। সাধু ন্যায়বিচার না করলে তার সাধুত্ব মূল্যহীন।
কোরআনেও মানুষকে বিনয়ী হওয়ার নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, সংযত হয়ে চলাফেরা করো এবং তোমার কণ্ঠস্বরকে সংযত রাখো। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর। (সুরা লোকমান ৩:১৯)। মহামানবেরা নিজেকে দীন, হীন, দাস, অজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দেন। অজ্ঞরাই নিজেকে বিজ্ঞ ভাবে। কিন্তু সুন্দর জীবনে বিনয়ের বিকল্প নেই। গায়ের জোরে রাজ্য দখল করা যায়, রাজা হওয়া যায়, কিন্তু ভক্তি, সম্মান পাওয়া যায় না। অসদাচরণ অহংকার দ্বারা কোনো জীবের হৃদয় জয় করা যায় না, বিনয়ের দ্বারাই জয় করা যায়। আর বিনয় যদি শিখতে চাও, লালনের কাছে যাও।
আজ ১৭ অক্টোবর (১ কার্তিক) ২০২২, লালন সাঁইজির ১৩২তম তিরোধান দিবস। এ উপলক্ষ্যে তার স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক :সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর