বাংলাদেশের ফুটবলে একাধিক এজেন্ট থাকলেও কেউই ফিফা স্বীকৃত ছিলেন না। এই জায়গাতেই এসে যাচ্ছে নিলয় বিশ্বাসের নাম। ফিফার লাইসেন্সধারী প্রথম বাংলাদেশি ফুটবল এজেন্ট তিনি। দিনকয়েক আগে এই স্বীকৃতি পাওয়া নিলয় একসময় মেডিকেলে ভর্তি বাতিল করেছিলেন! ফিফা এজেন্ট হওয়ার সঙ্গে তার জীবনের সেই গল্পও উঠে এলো।
প্রশ্ন: একেবারে শুরু থেকে শুরু করা যাক। মানে একেবারে ছেলেবেলার কথা। হতে চেয়েছিলেন তো ফুটবলার…
নিলয় বিশ্বাস: আসলে ছোটবেলায় সবাই আমরা খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত থাকি। সেখান থেকেই ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। আমার যখন বেড়ে ওঠা, তখন ফুটবল ক্রেজ ছিল। ক্রিকেটের এতটা আধিপত্য ছিল না। ওই সময় পাড়া-মহল্লায় ফুটবলের চর্চা হতো। সেখান থেকে আসলে ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছে জাগে। তবে হুট করে একটা ইনজুরি হয়। সেই কারণে আর ফুটবলার হওয়ার দিকে এগোতে পারিনি। তবে ফুটবলকে আগেও ভালবাসতাম, এখনও ভালোবাসি।
প্রশ্ন: ফুটবলার হতে পারেননি। কোনও আক্ষেপ আছে কি?
নিলয় বিশ্বাস: আক্ষেপ একটা সময় হতো। কারণ ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। জাতীয় দলের জার্সি গায়ের জড়ানোর স্বপ্ন ছিল। আমার অনেক বন্ধু এবং পরিচিত বড় ভাই বর্তমানে জাতীয় দলে খেলছে। ইনজুরি না হলে, হয়তো আমিও তাদের মতো জাতীয় দলে খেলতে পারতাম। তবে আমার ইচ্ছে ছিল আমি যেন খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারি। আর তাই ক্রীড়া সাংবাদিক হওয়ার লক্ষ্যে সাংবাদিকতায় পড়াশোনা করি। যেন মাঠে গিয়ে খেলা দেখতে পারি। তবে এখন ফুটবলের সঙ্গে আছি, ফুটবলের সঙ্গে কাজ করতে পারছি। তাই এখন আর কোনও আক্ষেপ নেই।
প্রশ্ন: বোঝাই যাচ্ছে ফুটবল এজেন্ট হওয়ার আনন্দ আপনার কাছে অন্যরকম। এই জার্নির শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
নিলয় বিশ্বাস: আসলে ফুটবল এজেন্ট হবো, এমন কোনও চিন্তা ছিল না। আমি স্টেডিয়ামে গিয়ে বাংলাদেশের খেলা দেখতাম। এমনকি দেশের বাইরে গিয়েও বাংলাদেশের খেলা দেখতাম। তখন ভাবলাম যে, খেলা ছাড়া মাঠের বাইরে ফুটবলে কোনও প্রফেশন আছে কিনা। এরপর ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের ফুটবলকে পুরোপুরি ফলো করা শুরু করি। তখন পরিচিত ফুটবলারদের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করি। সেইসময় বাংলাদেশের যে বিদেশি ফুটবলাররা খেলতো, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়। তখন তাদের কাছে জানতে চাই, তোমরা বাংলাদেশে আসছো কীভাবে। তখন তাদের কাছে থেকে জানতে পারি এজেন্ট সম্পর্কে। এরপর অনলাইনে কিছু রিসার্চ করি। এরপর ২০১৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় সাবিনা খাতুন আপার সঙ্গে প্রথম এজেন্ট হিসেবে কাজ করি।
প্রশ্ন: সেই থেকে চলছে আপনার এজেন্ট ক্যারিয়ার। তো আপনারা, মানে ফুটবল এজেন্টরা কীভাবে কাজ করে থাকেন?
নিলয় বিশ্বাস: একজন ফুটবল এজেন্টের ব্যাপ্তিটা অনেক। একজন এজেন্ট শুধুমাত্র ফুটবলার না, কোচ বা ক্লাবেরও এজেন্ট হতে পারে। কোনও খেলোয়াড়ের ক্লাব দরকার হলে তাকে ক্লাব দেওয়া কিংবা কোনও ক্লাবের খেলোয়াড় দরকার পড়লে খেলোয়াড় দিয়ে থাকে। এজেন্টরা মূলত দলবদলের প্রক্রিয়াটি দেখাশোনা করে। দলবদলের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন মাথায় রেখে কাগজপত্র তৈরি করে। একজন খেলোয়াড় যাতে ক্লাব কর্তৃক বা ক্লাব খেলোয়াড় কর্তৃক প্রতারিত না হয়, এজন্য এসব জটিল বিষয়গুলো দেখাশোনা করে থাকে এজেন্টরা।
প্রশ্ন: ইউরোপিয়ান ফুটবলে যতটা পেশাদারিত্বের সঙ্গে দলবদল হয়, বাংলাদেশে তেমনটা দেখা যায় না। এর কারণ কী?
নিলয় বিশ্বাস: ফুটবল আসলে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা না। এটা আমরা পশ্চিমাদের কাছে থেকে পাওয়া। যখন আমরা বাইরের থেকে কোনও কিছু ফলো করি তখন ওই জিনিসটা পুরোপুরি হয় না। ফুটবলে ইউরোপীয় ফুটবল স্ট্যান্ডার্ডকে পুরো বিশ্ব ফলো করে। অন্যান্য দেশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে করলেও আমরা এখনও তা করতে পারিনি। ক্লাবগুলোর সঙ্গে ফুটবলারদের ভালো সম্পর্কের কারণে তারা সরাসরি কথা বলে দলবদল করে। যা লিখিত থাকে না। যার ফলে মাঝে মাঝে ফুটবলাররা টাকা না পাওয়ার অভিযোগ তোলে। আবার এক ফুটবলারের দুই ক্লাব থেকে টাকা নেওয়ার ঘটনা ঘটে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে এই পেশার ভবিষ্যৎ কেমন বলে মনে করেন?
নিলয় বিশ্বাস: যেহেতু এটা ফুটবল রিলেটেড একটা পেশা। আর আমাদের দেশের ফুটবল বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। এই পেশাটা নির্ভর করবে বাংলাদেশ ফুটবল কতটা এগোচ্ছে, তার ওপর। বাংলাদেশের ফুটবল যদি এগিয়ে যায়, তাহলে এই পেশার সম্ভাবনাও বাড়বে। এটা পুরো নির্ভর করবে দেশের ফুটবল কতটা উন্নতি করছে, তার ওপর। আর ফিফা এজেন্ট হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, ফিফা অন্তর্ভুক্ত ২১১টি দেশে কাজ করার সুযোগ থাকে। এটা খুবই ভালো একটা পেশা। তবে বেশ চ্যালেঞ্জিং। এই পেশায় সফলতা পেতে গেলে ধৈর্য ধরতে হবে। রাতারাতি সফলতা আসবে না।
প্রশ্ন: যারা ফুটবল এজেন্ট হতে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
নিলয় বিশ্বাস: যদি কেউ এই পেশায় আসতে চায় তাকে স্বাগত। যারা ফুটবলকে ভালবাসে, এটা তাদের জন্য খুবই ভালো একটা পেশা। তবে বেশ চ্যালেঞ্জিং। রাতারাতি সফলতা আসবে না। তবে এই পেশায় থাকলে দেখা যাবে মাঠে গিয়ে খেলা দেখতে পারবে। অনেক বড় বড় খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হবে। অনেক উপভোগ করা যায়।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মা-বাবার চাওয়া থাকে, ছেলে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। সেই জায়গায় আপনি একটা ব্যতিক্রমী পেশা বেছে নিয়েছেন। পরিবার থেকে কেমন সহযোগিতা পেয়েছেন?
নিলয় বিশ্বাস: পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া তো আর এতদূরে আসা যায় না। বাবা-মার কাছ থেকে প্রচুর সাপোর্ট পেয়েছি। আমার বাবা-মাও চাইতো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হই। এমনকি ২০১৭ সালে আমি মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পুরো প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ভর্তি হওয়ার দিন আমি ভর্তি না হয়ে চলে আসছি, মানে ভর্তি বাতিল করি। সেই সময়ও বাবা-মা আমাকে সাপোর্ট করছে। একটা প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াশোনা করতে যা টাকা লাগে তার চেয়ে বেশি আমি আয় করেছি।
প্রশ্ন: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
নিলয় বিশ্বাস: আমার একটা এজেন্সি আছে। বেঙ্গল সকার এজেন্সি। এই এজেন্সি দিয়ে সর্বপ্রথম সাবিনা আপাকে নিয়ে কাজ করি। যদি কখনও বাংলাদেশের ফুটবল উন্নতি করে, বাংলাদেশের ফুটবলারদের চাহিদা দেশের বাইরে বৃদ্ধি করা নিয়ে কাজ করতে চাই। কারণ বাংলাদেশের একজন ফুটবলার যদি বাইরের বড় লিগে খেলতে পারে তাহলে সেই অভিজ্ঞতা অন্য ফুটবলারদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে। বাংলাদেশ জাতীয় দল উপকৃত হবে।