সুস্থ শরীরের জন্য যেমন সুষম খাদ্য জরুরি, তেমনি প্রফুল্ল মন ও মেধা বিকাশের জন্য প্রয়োজন সুস্থ বিনোদন। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে চিত্তবিনোদন একটি। কিন্তু ইদানীং যেখানে অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণেই হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত সময় ও অর্থ ব্যয়ের সামর্থ্য নেই বেশির ভাগ মানুষের। এ কারণে হাতে থাকা স্মার্টফোনই হয়ে উঠেছে মানুষের সহজলভ্য বিনোদনের প্রধান উপায়। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারের মতো সামজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে কাটছে বিনোদনের জন্য বেশির ভাগ সময় । কিন্তু আসলেই কি এতে সুস্থ বিনোদনের খোরাক মিটছে?
অধিকাংশ শিক্ষার্থী বা তরুণ প্রজন্ম সময় পেলেই ঢুঁ মারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মনের অজান্তেই কাটিয়ে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু এতে দেখা যায়, বিনোদন কিংবা বিশ্রামলাভের পরিবর্তে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তারা। তরুণদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দৈনিক ছয় ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করেন ২৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী। গবেষকদের মতে, দৈনিক গড়ে ৩০ মিনিটের বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করলে তা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ২০১৭ সালে ‘রয়্যাল সোসাইটি অব পাবলিক হেলথ’-এর এক গবেষণা অনুযায়ী, স্ন্যাপচ্যাট ও ইনস্টাগ্রাম হীনম্মন্যতা ও দুশ্চিন্তা সৃষ্টির কারণ। এতে বুদ্ধির বন্ধ্যত্ব তৈরি হচ্ছে। বিঘ্নিত হচ্ছে মেধার বিকাশ। মানহীন ও কুরুচিপূর্ণ নাটক, মিউজিক ভিডিও ও শর্টফিল্মের ছড়াছড়ি। এসবের ফলে সুস্থ বিনোদনের পরিবর্তে বেড়েই চলেছে অপসংস্কৃতির চর্চা।
মনে রাখা জরুরি, সুস্থ-মননশীল বিনোদনের মাধ্যমগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ায় একদিকে যেমন শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন বড়রাও। এভাবে চলতে থাকলে তা হবে মহা সর্বনাশের কারণ! এ থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়, অবস্থার উত্তরণ ঘটানো যায়, তা-ই আজকের দিনে প্রধান আলোচ্য বিষয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে মাথাপিছু ৯ বর্গমিটার খোলা মাঠের প্রয়োজন। কিন্তু সর্বশেষ এক হিসাবে ঢাকায় জনপ্রতি দশমিক ১ বর্গমিটারেরও কম মাঠ রয়েছে—কী অদ্ভুত কথা! এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী একটি উক্তি বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার—‘এই যে খেলার মাঠ সব দখল হয়ে যাচ্ছে, ছেলেরা সব কই যাবে? রাস্তাঘাটে ঘুরবে, অকারণে বাজারে যাবে, মানুষের পকেটে হাত ঢোকাবে।’ সত্যি বলতে, তাজউদ্দীন আহমদের কথা আজ বাস্তব হয়ে প্রতিঘাত করছে! অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই, বিনোদনের সুষ্ঠু বন্দোবস্ত ও সুযোগ-সুবিধা না থাকায় দেশের যুবসমাজ বিপথগামী হচ্ছে। তরুণদের একটা বড় অংশকে নেশা গ্রাস করছে। অর্থাৎ, বিনোদনের সুস্থ পরিবেশ অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে বই পড়ার অভ্যাস ও পরিবারের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার মতো যুগপৎ ফলপ্রসূ ও সুস্থ বিনোদনমাধ্যমগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা সময়ের দাবি। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে অভিভাবকদেরও। সন্তানকে চোখে চোখে রাখতে হবে। তার খোঁজখবর নিতে হবে। তার সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এক কথায়, পরিবারকেই সুস্থ বিনোদনের মূল কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে অশ্লীলতা প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট মহলের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, শুধু আইন করে এ সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না। এর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সুস্থ বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা। সমাজে সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক কাজের পরিসর ও গতি বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে সচেতন ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি।