আদিকালে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মানবজাতি সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করেছিলো। নিঃসন্দেহে তখন মানবসম্প্রদায় নিজ জাতের সাথে বৈরিতা থেকে সচেতনভাবে বিরত থাকতো। ভাষা ছিলো না, ইশারায় মনের ভাব প্রকাশ দ্বারা পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করতো। তারা বুঝতো যে, প্রত্যেকে স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষায় বন্যদের সাথে জীবনসংগ্রাম করছে। তাই সবকাজে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ছিলো। অতঃপর সেই বোধ থেকে মানুষের মধ্যে উন্নত সমাজ গড়ার প্রত্যয় তৈরি হয়।
সে সময়টা কয় শতাব্দীব্যাপী বিরাজমান ছিলো, অনুমান করা না গেলেও তখন মানবসমাজে দ্বন্দ্বের চেয়ে ভ্রাতৃত্ব ও সংহতি বেশি ছিল— গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে সে যুগ আধুনিক মানুষের সমাজবদ্ধ জীবনের সূচনাকাল ছিলো বলে সহজে ধারণা করা যায়। বলা হয় আফ্রিকায় আধুনিক মানুষের (Homosapiens) আবির্ভাব ঘটে। তারা মূলত ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সমাজজীবনে অভ্যস্ত হয়। অতঃপর তারা টিকে থাকার তাগিদে একদেশ থেকে অন্যদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই যুগে সবমহাদেশে মানুষের অস্তিত্ব না থাকলেও যেখানেই থাকতো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বাস করতো। যদিও খাদ্য ও পানির সহজলোভ্যতার জন্য তারা যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তার কয়েক হাজার বছর পর মানুষ ধাতুর ব্যবহার শেখে ও মানবশিশুর প্রাণ সংহারকারী হিংস্র পশুবধে ধাতু নির্মিত অস্ত্রের ব্যবহার করায়ত্ত করে। ফলে পশুরা মানুষ থেকে দূরত্ব অবলম্বন করতে বনবাসী হয়। আর মানুষ আরও সমৃদ্ধজীবন ও শান্তি চায়। শুরু হয় শান্তিপূর্ণ মানবসমাজ গঠনের যুগ। অতঃপর এই শান্তি বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। কেননা মানুষকে সম্পদ অর্জন এবং তা পুঞ্জীভূত করার মোহ পেয়ে বসে।
বস্তুত আদিকালের সেই শান্তসমাজ অশান্ত হয় সম্পদ পুঞ্জীভূত করার মানবিক প্রবণতা দ্বারা। যা ক্রমশ মানুষকে ব্যক্তিসম্পদ আরোহন এবং ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ জমিয়ে রাখার প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেয়। আরও কয়েক হাজার বছর পরে সেটা পুঁজিবাদী দ্বন্দ্বে পরিণত হয় এবং মানুষকে তীব্র দ্বন্দ্ব বা দলবদ্ধ যুদ্ধ-বিগ্রহের দিকে ধাবিত করে।
তদুপরি মানুষের সবচে’ বেশি কাঙ্ক্ষিত বিষয় হলো শান্তি। ব্যক্তিগত শান্তি বজায় রাখা বেঁচে থাকার প্রথমশর্ত। অনুরূপ মানুষের শেষ আকাঙ্ক্ষাও হলো অতিরিক্ত সম্পদ পুঞ্জীভূত করা। সম্পদশালী ব্যক্তিকে ধনি মানুষ বলা হয়। ধনাঢ্য অবস্থা চায় না, তেমন মানুষের অস্তিত্ব নাই। ফলে সম্পদহীনতা ও দারিদ্র কোনও মানুষের কাঙ্ক্ষিত নয়। সম্পদ আরোহন মূলত আর্থিক কাজ। এর বইরের সমস্ত কাজ অনর্থক। যা কেউ করতে চায় না।
আর আর্থিক কাজগুলো বেশি সফল হয় দলবদ্ধ হয়ে সম্পন্ন করলে। সেজন্য মানবসমাজে দলবদ্ধ কাজের প্রতি আগ্রহ বেশি। নিজ সম্পদ অর্জনের মাধ্যম শক্ত-পোক্ত করতে মানবসমাজে দলবদ্ধ কর্মপন্থা তৈরি হয়। এটাই আসলে পেশা হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। প্রতিটি পেশাগত কাজের মূল অনুপ্রেরণা হলো অর্থ উপার্জন। যার প্রভাবে পেশাগত প্রতিযোগিতা শুরু হয় ও মানবসমাজ দুই শ্রেণিতে ভাগ হয়ে যায়; যথা : ধনিক বা মালিক শ্রেণি এবং শ্রমিক শ্রেণি।
মালিকরা অমুখাপেক্ষী এবং সমস্ত আর্থিক সংগঠনের শাসক। তাদের অধিনস্ত সবাই বেতনভোগী শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী। বেতনভোগী ব্যক্তি যত বড় কর্মকর্তা হোক, আসলে সে মালিক শ্রেণির অন্তর্গত নয়— মালিকানার বাইরে সকল পেশাজীবী মানুষ শ্রমজীবী শ্রেণির অন্তর্গত। কেননা আর্থের বিনিময় বেতনভোগীদের সমস্ত মেধা ও শ্রম বিক্রি হয়ে যায়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারে না বলে তারা তুলনামূলক কম বা স্বল্প সম্পদের অধিকারী হয়। ফলে এদের বেকার ও বার্ধক্যকালে অর্থ সংকট হয়। তাই শ্রমজীবী মানুষ সর্বদা ভবিষ্যত অসচ্ছলতার চিন্তায় শঙ্কিত থাকে। সুতরাং কম সম্পৎশালী শ্রমজীবী মানুষরা সদা মালিকদের কাছে নিজেদের পেশার সর্বোচ্চ মূল্য দাবি করে।
উল্লেখ্য, ধনবান মালিক শ্রেণি শ্রমের চেয়ে কখনও অধিকমূল্য দেয় না। বরং শ্রমঘণ্টা সংকোচিত করতে চায়; এমনকি অনেকক্ষেত্রে শ্রমের ন্যায্যমূল্য দিতেও অনাগ্রহ প্রকাশ করে। মালিক শ্রেণি কম বিনিয়োগে বেশি মুনাফা চায়। আর্থিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা, কাঁচামাল যোগান দেওয়া ও শ্রম, এর সবই মালিকদের বিনিয়োগ।
মূলত মালিক-শ্রমিক চিরায়ত দ্বন্দ্বের সূত্রপাত উল্লেখিত কারণগুলো থেকে।
এই দ্বন্দ্বের মাঝে যুক্তির চেয়ে আবেগের মাত্রা প্রবল থাকে। সম্পৎশালীরা এক্ষেত্রে নিজেদের সম্পদের দ্বারা একদল পেশাজীবীর বিরুদ্ধে অন্য পেশাজীবী লেলিয়ে দেয়, শুরু হয় বিদ্রোহ। রাষ্ট্রযন্ত্রও মালিক শ্রেণির পক্ষালম্বন করে। তখন ঘটে প্রাণহানীর মতো মারাত্মক ঘটনা। মে-দিবস তারই উদাহরণ। তথাপি সে বিদ্রোহ দমন করা যায়নি। বিদ্রোহ দমনে উদ্যোত ধনিকশ্রেণি পরবর্তীকালে বিদ্রোহের কারণ অনুধাবন করে এবং তা ক্রমশ শান্তিপূর্ণ উপায় সমাধান করতে রাষ্ট্রের সহযোগিতা কামনা করে।
সমাধানে যাওয়ার কারণ হলো মালিকদের আর্থিক সংগঠনগুলোর শ্রমের অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখা। নইলে উৎপাদন হবে না এবং তাদের ধনাঢ্য অবস্থা ধীরে ধীরে অবনতি ঘটবে। আর রাষ্ট্রব্যাপী আর্থিক বৈকল্য সৃষ্টি হবে; যা কারোই কাম্য নয়। ফলে তারা সরকারের মধ্যস্থতায় শ্রমজীবী মানুষের কতিপয় দাবী মেনে নেয়। আর শ্রমজীবীরাও আর্থিক সঙ্গতির কথা বিবেচনা করে নিজেদের শক্ত অবস্থান থেকে সরে এসে কিছুক্ষেত্রে ছাড় দিতে বাধ্য হয়। নইলে মাসের শেষে বেতন আসে না— সংসার চালাতে নিরবচ্ছিন্ন মাসিক আয়ের বিকল্প নাই। এই প্রক্রিয়া কৃষি, শিল্প সবখানে সমান।
মে দিবস মূলত মানবসমাজে ঘটমান এই চিরায়ত এবং ধারাবাহিক দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক দিন। ইতিহাসের ইতিবৃত্ত যাই হোক, ১-মে, ১৮৮৬-সালে শিকোগোর সেই হত্যাকাণ্ড না হলে, আজ আমরা ৮-ঘন্টা দৈনিক কাজের নির্ধারিত সময় পেতাম কি-না, সন্দেহ আছে। ভুল করে পরবর্তীতে শুদ্ধতার দিকে যাওয়া শুধু শান্তির জন্যই মানুষ করে। যা তার প্রকৃতিগত চেতনা।
কার্যত শান্তির জন্য সামাজিক এসব কর্মকাণ্ড মানবসভ্যতা বিকাশের ধারাবাহিক রূপ। সম্পদ অর্জন এর প্রভাবক (Catalyst)। সম্পদ অর্জনের আগ্রহ মানবসমাজে তৈরি না হলে, কোনও দ্বন্দ্ব থাকতো না। তাই এই অনির্বচনীয় সত্য তথা শান্তির প্রতি নিরবচ্ছিন্ন আগ্রহ মানুষ সর্বদা বুকে ধারণ করে চলে। সুতরাং দ্বন্দ্বের চরমাবস্থা বা যুদ্ধের সময়কাল, মহাকালের তুলনায় সীমিত আকারে হয়ে থাকে। বস্তুত যে মৌলিক আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে আজ অবধি মানুষ এই পৃথিবীর বুকে চলে, সেই শান্তির সময়কে আমরা স্বাভাবিক সময় বলি।
দুনিয়ার সকল খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের জয় হোক।
i5554i