ভারতের সুপরিচিত অ্যাক্টিভিস্ট ও সমাজকর্মী তিস্তা সেতালভাদকে গুজরাট পুলিশ তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছে, এর ফলে নিন্দায় সরব হয়েছে বহু মানবাধিকার সংগঠন, প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বিশিষ্ট আইনজীবীরাও। সুপ্রিম কোর্ট গুজরাটের দাঙ্গায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দায়মুক্তি বিষয়ক একটি মামলার সূত্র ধরে মিস সেতালভাদের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেন।
এর প্রায় সাথে সাথেই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও শাসক দল বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যেই তার সমালোচনা করে বিবৃতি দেন। এর পরই তিস্তা সেতালভাদের মুম্বাইয়ের বাড়িতে গিয়ে তাকে আটক করে গুজরাট পুলিশের অ্যান্টি-টেররিজম স্কোয়াড।
রোববার বিকেলে আহমেদাবাদের একটি আদালতে তাকে হাজির করে ১৪ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ।
ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচ দিনের রিমান্ড মনজুর করেছেন।
নিজ ইউটিউব চ্যানেলে তিস্তা নিজেকে শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় স্বজনহারানোরা যেন ন্যায়বিচার পান সে জন্য দুদশক ধরে লড়াই চালিয়ে আসছেন তিস্তা জাভেদ শেতালভাদ ও তার এনজিও সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস (সিজেপি)।
দাঙ্গাপীড়িতদের যথাযথ আইনি সহায়তা আর্থিক সাহায্য পায় সে উদ্দেশ্য নিয়েই গুজরাট দাঙ্গার ঠিক পর পরই ওই এনজিও-টি গড়ে তোলা হয়েছিল।
কিন্তু সিজেপি কোথা থেকে অর্থ পাচ্ছে, বিদেশী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এনজিও-টি অবৈধভাবে তহবিল সংগ্রহ করছে কি না- তা নিয়ে বিজেপি আমলে সেতালভাদকে বার বার প্রশ্নের মুখে পডড়েছেন।
২০০৭ সালে কংগ্রেস আমলে তিনি ভারতের অন্যতম শীর্ষ বেসামরিক খেতাব ‘পদ্মশ্রী’তে ভূষিত হয়েছিলেন।
গুজরাট দাঙ্গায় রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অব্যাহতিকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন সেতালভাদ ও জাকিয়া জাফরি- যার স্বামী ও কংগ্রেস নেতা এহসান জাফরিকে দাঙ্গাকারীরা জীবন্ত জ্বালিয়ে হত্যা করেছিল।
জাকিয়া জাফরি মূল আবেদনকারী হলেও তিস্তা সেতালভাদ ছিলেন সেই মামলার কো-পিটিশনার।
গত শুক্রবার (২৪ জুন) সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ সেই মামলা খারিজ করে দিয়ে মন্তব্য করে, তিস্তা সেতালভাদ মিস জাফরির আবেগকে অন্যায়ভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
বিচারপতি এ এম খানউইলকরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ আরও বলে, ‘মিস সেতালভাদ চাইছেন দাঙ্গা নিয়ে বিতর্ক জিইয়ে রাখতে।
এরপরই বার্তা সংস্থা এএনআই-কে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়ে সেতালভাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
অমিত শাহ ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বহু ভিক্টিমের হয়ে এনজিও-ই হলফনামায় সই করে দিত, তারা জানতও না কিছু। সবাই জানে তিস্তা সেতালভাদের এনজিও এসব করে আসছিল।’
তিনি বলেন, ‘কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার তিস্তা সেতালভাদের এনজিওকে প্রচুর সাহায্য করেছে, এটা দিল্লিতে সবারই জানা।’
সেতালভাদের মতো কেউ কেউ লাগাতার প্রধানমন্ত্রী মোদিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এমনও ইঙ্গিত করেন তিনি।
দলীয়ভাবে বিজেপিও তিস্তা সেতালভাদের পুরনো সব কাজকর্ম নিয়ে তদন্তের দাবি জানায়।
বিজেপি মুখপাত্র সম্বিত পাত্র সুপ্রিম কোর্টের রায়কে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘বিচারপতিরা তিস্তা সেতালভাদের নাম করে বলেছেন তার আগের সব ইতিবৃত্ত খতিয়ে দেখা দরকার- কারণ তিনি প্রকৃত ভিক্টিমদের আবেগ আর সেন্টিমেন্টকে এক্সপ্লয়েট করে নিজের দুরভিসন্ধি সিদ্ধ করতে চাইছেন।’
এরপর শনিবার সকালেই গুজরাট পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের একজন ইনস্পেক্টর তিস্তা সেতালভাদ ও রাজ্যের আরও দুজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আর বি শ্রীকুমার ও সঞ্জীব ভাটের বিরুদ্ধে নথিপত্রে জালিয়াতি করা-সহ বিভিন্ন অভিযোগে এফআইআর নথিভুক্ত করেন।
সেদিন বিকেলই গুজরাটের অ্যান্টি-টেররজিম স্কোয়াড (এটিএস) পৌঁছে যায় তিস্তা সেতালভাদের মুম্বাইয়ের বাড়িতে।
এটিএসের মোট ছয়জন অফিসার তিস্তার বাড়িতে হানা দেন, যার মধ্যে দুজন ছিলেন মহিলা। সিনিয়র এটিএস অফিসার জেসমিন রোসিয়া পরে তাদের সাথে যোগ দেন বলে সেতালবাদের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানানো হয়েছে।তার পরিবারের সদস্যরা আরও দাবি করেছেন, এফআইএরের কোনো প্রতিলিপি বা গ্রেফতারি পরোয়ানা না-দেখিয়েই সেতালবাদকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়।
গ্রেফতার দেখিয়ে সড়কপথে নিয়ে আসা হয় আহমেদাবাদে। সেখানে মেডিক্যাল টেস্ট করে রোববার দুপুরের পর তাকে আদালতে পেশ করা হয়।
আদালতে ঢোকার সময় তিস্তা সেতালভাদ বাইরে অপেক্ষারত সাংবাদিকদের জানান, এখানে কিছু বলব না- যা বলার ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বলব।
এই গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলে, তিস্তা সেতালভাদকে যেভাবে আটক করা হয়েছে তা সুশীল সমাজকে হুমকির মুখে ফেলবে এবং ভারতে প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে আরো স্তিমিত করবে।
তিস্তা সেতালভাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিবৃতি দেয় অল ইন্ডিয়া ডেমোক্র্যাটিক উইমেনস অ্যসোসিয়েশনও।
বামপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট শবনম হাশমি বলেন, ‘শুধু তিস্তাই নন- আমরা দেখতে পাচ্ছি এদেশে যারাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন, আট বছর আগে মোদি সরকার আসার পর তাদের সঙ্গে এরকমই নির্যাতন করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘গৌরী লঙ্কেশ, পানসারে, কালবুর্গীদের-কে তো মেরেই ফেলা হয়েছে। আসলে এই ফ্যাসিস্ট ও কর্তৃত্ববাদী সরকার চাইছে যারা এতটুকুও কথা বলছেন, তাদেরকেও ভয় দেখিয়ে ঘরে বসিয়ে দিতে। ‘জাকিয়া জাফরির করা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণেরও সমালোচনা করছেন অনেক আইনজ্ঞ।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ গৌতম ভাটিয়া বিদ্রূপাত্মক টুইট করে লিখেছেন : বিশ্বের আইন-দর্শনে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের অবদান হলো- একটি ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্র মামলায় তারা রাষ্ট্রকেই নির্দেশ দিয়েছেন ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে!