সুমিত রায়।
কনজার্ভেটিভ লিডারশিপ ইলেকশনে লিজ ট্রাস ৫৭% এলিজিবল ভোটে ঋষি সুনাককে হারিয়েছেন। এরপরই তিনি স্পিচ দিয়ে বোরিস জনসনের প্রশংসা করলেন, বললেন তিনি ব্রেক্সিট করেছেন, জেরেমি করবিনকে ক্রাশ করেছেন, ভ্যাক্সিন এনেছেন, পুতিনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তবে জনসনকে এত প্রশংসায় ভাসালেও ট্রাসের বিভিন্ন পলিসি কিন্তু জনসনের বিরুদ্ধেই যায়। ইকোনমিক পলিসির ক্ষেত্রে আসি। জনসন ট্যাক্স বৃদ্ধি করতে পিছপা হননি, তিনি লেভেলিং আপের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু ট্রাস ট্যাক্সেশনের বিরুদ্ধে, এবং ইনিকুয়ালিটি নিয়ে খুব একটা ভাবিত নন। একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, তার মতে রিডিস্ট্রিবিউশন ভুল, মানে ধনির টাকা নিয়ে গরিবদের মধ্যে বণ্টন করার পলিসি ভুল, তিনি ইকোনমির বৃদ্ধিতে বিশ্বাস করেন, কারণ এটা সকলের জন্যই আল্টিমেটলি মঙ্গলজনক হয়। তিনি মনে করিয়ে দেন এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বলেন বিগত ২০ বছর ধরে ইকোনমির আলোচনা চলেছিল ডিস্ট্রিবিউশন নিয়ে, কিন্তু এটা করতে গিয়ে গ্রোথ হয়েছে মাত্র ১%, আর তার ফলে দেশটি পিছিয়ে আছে, তাই ধনীরা আরও ধনী হবে তা ন্যায্য…। এদিকে জনসন গ্রিন পলিটিক্স ও নেট জিরো নিয়ে প্যাশনেট ছিলেন, কিন্তু ট্রাস গ্রিন লেভিস অর্থাৎ পল্যুশন ও কার্বন এমিশনের জন্য বরাদ্দকৃত ট্যাক্স তুলে নিতে চান, আর ফ্র্যাকিং মানে ফসিল ফুয়েল উত্তোলন বৃদ্ধি করতে চান। একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ইউরোপ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, আমরা কখনই এই পজিশনে যেতে চাইনা। এজন্য আমাদেরকে রিনিউয়েবল, নিউক্লিয়ার ডেভলপ করতে হবে, ইউরোপের সাথে এনার্জির অল্টারনেটিভ ওয়ে নিয়ে ডিলিং-এ যেতে হবে, নর্থ সি এর রিসোর্স বেশি করে ব্যবহার করতে হবে, আমাদের নিজেদের গ্যাস ফিল্ডগুলো কাজে লাগাতে হবে, আর খুব দ্রুতই এগুলো করতে হবে। ইকোনমিক্সের দিকে ট্রাস লো ট্যাক্স ও হাই স্পেন্ডিং এর পক্ষে। কিন্তু দেশে যদি ট্যাক্স রেভিনিউ বা আয় কমে, কিন্তু স্পেন্ডিং বা ব্যয় বাড়ে (যেটা নতুন এনার্জি প্রোজেক্টগুলোর জন্য ও ডিফেন্সের পেছনে করতে হবে), তাহলে ব্রিটিশ সরকারকে ডেফিসিটে চলতে হবে, ঋণ বেড়ে যাবে। কিন্তু ট্রাস বলছেন এটা হলে ডেট বা ঋণ বাড়লেও একই সাথে জিডিপি বাড়বে, এর ফলে ডেট টু জিডিপি রেশিও কমে আসবে (প্রকৃতপক্ষে ডেট টু জিডিপি রেশিওই আল্টিমেটলি ডেটের চেয়ে বেশি ম্যাটার করে, কেননা আপনি একজন গরিবকে ১০০০ টাকাও ধার দেবেন না, কিন্তু ধনীকে এক লাখ টাকা ধার দিতেই পারেন, কারণ সিকিউরিটি…)। তাছাড়া ইন্টারেস্ট রেইট এখনও কম, ফলে দেশটি সহজেই ঋণ নিতে পারবে। সেই সাথে এই বরোয়িংগুলোর কিছু কিছু ডেট (debt) এর রিফাইনান্সিং এর মাধ্যমে মিটিগেইট করা যাবে। সেক্ষেত্রে গভার্নমেন্ট বন্ডগুলোর ম্যাচুইরিটির এভারেজ লেংথ বাড়াতে হবে আর কিছু কিছু ডেটকে স্পেশাল কোভিড ডেট হিসেবে ডেজিগনেট করে দূর ভবিষ্যতে পে-অফ করার কথা বলতে হবে। আর এজন্যই দেশের ঋণ বৃদ্ধি নিয়ে তিনি চিন্তিত নন।
যাই হোক, তার ট্যাক্স পলিসি নিয়ে আলোচনা করা যাক। তিনটি খাতে তিনি ট্যাক্স কাট করতে, অর্থাৎ ট্যাক্স কমিয়ে দিতে চান। প্রথমত তিনি ন্যাশনাল ইনশিউরেন্স কমিয়ে দিতে চান, এটা অলরেডি বৃদ্ধিতে চলছে, কিন্তু ২০১৯ সালেই কনজারভেটিভরা তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে বলেছিলেন যে এটা তারা আর বাড়তে দিতে চান না। দ্বিতীয়ত তিনি করপোরেশন ট্যাক্স হাইককে রিভার্স করতে চান, যা পরের বছর ১৯ থেকে ২৫%-এ রাইস করার কথা ছিল। তৃতীয়ত গ্রিন লেভিস আটকানো, এটা নিয়ে একটু আগেই বললাম, তিনি পল্যুশন ও কার্বন এমিশনের জন্য ট্যাক্স তুলে দিতে চান, তবে এটা তিনি অস্থায়ী সময়ের জন্য করবেন জানিয়েছেন। বেশ কয়েকদিন ধরে বলাবলি হচ্ছে ট্রাস এনার্জি বিল ফ্রিজিং করার কথা বলছেন, মানে তিনি এনার্জির দাম বেঁধে দেবেন, তা বাড়তে বা কমতে দেবেন না। কিন্তু তা নিয়ে কোন নিশ্চয়তা নেই। নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সাক্ষাতকারেও দেখা গেছে তিনি দরিদ্র পরিবারগুলোকে সাপোর্ট করার জন্য কেবল ট্যাক্স কাটই করবেন, এনার্জি বিল ব্রিজিং নিয়ে কিছু তাকে বলতে দেখা যায়নি। ইন্টারভিউতে লরা কুয়েন্সবার্গ ট্রাসকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি ন্যাশনাল ইনশিউরেন্স রাইস কাট করতে চান, কিন্তু দেখা গেছে এতে দরিদ্রতমরা মাত্র ৭ পাউন্ড পাবেন, কিন্তু ধনীরা পাবেন ৯০০ থেকে ২০০০ পাউন্ড, এটা কি ন্যায্য? জবাবে ট্রাস বলেছিলেন, ধনিরা বেশি ট্যাক্স দেয় বলে ট্যাক্স কাটে তাদের লাভবান হওয়াই বেশি স্বাভাবিক। কিন্তু এটা ন্যায্য হচ্ছে এই কারণে যে এর ফলে ইকোনমি গ্রো করবে, আর সেটা হলে সবাই উপকৃত হবে। যাই হোক, এখানে ট্রাস কী করতে চান তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে ট্যাক্স কাটাই তার একমাত্র স্ট্র্যাটেজি। আর সেই সাথে তিনি আরও বেশি অর্থ খরচ করতে চান। ক্যাম্পেইনে তিনি বলেছিলেন, তিনি ডিফেন্স স্পেন্ডিং বাড়িয়ে জিডিপি এর ৩% করতে চান, সেই সাথে তিনি সোশ্যাল কেয়ার স্পেন্ডিং কন্টিনিউ করবেন, যদিও ন্যাশনাল ইনশিউরেন্স রাইস উলটে দেবেন (যেটা কিনা সোশ্যাল কেয়ার স্পেন্ডিং-কেই ফাইনান্স করে!), ন্যাশনাল হেলথ সারভিসের বাজেট রিয়াল টাইমে বৃদ্ধি করবেন (ইনফ্লেশন বিবেচনা করেই), আর পেনশন ট্রিপল লক (ইনফ্লেশনের ফলে পেনশন বৃদ্ধি) কন্টিনিউ করবে। সত্যিকার অর্থে ট্রাস খরচ যেখানে কমাচ্ছেন তা হলো সিভিল সার্ভিস, তিনি বলেছেন তিনি ব্রেক্সিটের পূর্বে যে অবস্থা ছিল সেই অবস্থায় জব কাট করবেন বা চাকরি কমিয়ে দেবেন। আরেকটা জায়গায় কাট করবেন, তা হলো ওয়েলফেয়ার, যেখানে তিনি বলেছেন তিনি রিফর্ম চান।
এবার সোশ্যাল ইস্যুতে যাওয়া যাক। কালচার ওয়ার ইস্যুতে লিজ ট্রাস খুব শক্তভাবেই দক্ষিণপন্থী অবস্থান নেন। যেমন তিনি বিতর্কিত রুয়ান্ডা এসাইলাম সিস্টেমকে এক্সপান্ড করতে চান। রুয়ান্ডা এসাইলাম প্ল্যান হচ্ছে, যুক্তরাজ্যে যত অবৈধ ইমিগ্রেন্ট আছে, বা এসাইলাম সিকার আছে, এদের সবাইকে প্রোসেসিং-এর জন্য রুয়ান্ডায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। আর যারা ক্রীতকার্য হবেন তারা রুয়ান্ডাতেই বাস করবেন, এবং তাদেরকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করতে দেয়া হবেনা। লিজ ট্রাস এই সিস্টেমটাকেই আরও বাড়াতে চান। আর সিভিল সার্ভিসে খরচ কমানোর সময় তিনি বলেছিলেন, সিভিল সার্ভিসে আইডেন্টিটি পলিটিক্স ও ওকে কালচার বিদ্যমান। পরিবেশের ক্ষেত্রে ট্রাস গ্রিন লেভিস কমিয়ে দিতে চান। তবে তিনি এখনও নেট জিরো-তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আর তিনি এও বলেছেন যে, তিনি নিউক্লিয়ার এনার্জিতে প্রচুর বিনিয়োগ করবেন।
তো এগুলোই হলো লিজ ট্রাসের পরিকল্পনা। কিন্তু এই পরিকল্পনাগুলো কি জনপ্রিয়? যদি পোলিং এর দিকে তাকানো যায় তবে উত্তর হলো – খুব একটা নয়। পলিটিকোস,ইউকে এর পোলার পোল বলছে লেবর পার্টি এখন কনজারভেটিভদের থেকে ৯ পয়েন্টে এগিয়ে আছে, আর সম্ভবত এটা লিজ ট্রাসের কারণেই। ওপিনিয়ন পোলিং বলছে, মানুষ যতই ট্রাসকে দেখছে ততই তার ওপর আস্থা হারাচ্ছে। আগস্টের প্রথম দিকে ২০১৯ সালের কনজার্ভেটিভ ভোটারদের বিশাল সংখ্যক ট্রাসকে বিশ্বাসযোগ্য, লাইকেবল, কম্প্যাশনেট, সাধারণ মানুষের প্রতি বন্ধুসুলভ ও শক্তিশালী লিডার বলে মনে করেছিল। কিন্তু এক মাস ক্যাম্পেইনিং এর পর ও জনতার মুখোমুখি হবার পর সেটা রিভার্স হয়ে গেছে, এমনকি তার সাপোর্টাররাও তার বিরুদ্ধে চলে গেছে। যাই হোক, ২০২৪ সালের নির্বাচনের এখনও অনেক দেরি। কিন্তু যেটুকু সময় আছে, মনে হয়না ট্রাসের পক্ষে সম্ভব হবে তার পক্ষে সমর্থন বাড়ানো। আর তার প্রথম ১০০ দিনের পথকেও খুব একটা সরল নয়, বরং কণ্টকাকীর্ণ পথ বলেই মনে হচ্ছে, যেখানে তার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। শেষ পর্যন্ত কিভাবে তিনি এই চ্যালেঞ্জগুলো হ্যান্ডল করেন সেটাই ভাইটাল হয়ে দাঁড়াবে।
ট্রাসের এই রাজনীতি ইউরোপে এক নতুন রকমের রাজনীতি আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি হচ্ছে সংকটময় ইউরোপের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির রাজনীতি, যে রাজনীতিতে অনেক অধিক পরিমাণে ফসিল ফুয়েল উত্তোলন ও ডিফেন্স বাজেটের দিকে জোর দেয়, যার ফলে সরকারের স্পেন্ডিং বেড়ে যায়, সেটার জন্য সিভিল সার্ভিসে খরচ কমাতে হয়, এই রাজনীতি বর্ধিত ইকোনমিক গ্রোথের রাজনীতি, যার জন্য ট্যাক্স কাট করতে হয়, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারে খরচ কমাতে হয়, ন্যাশনাল ইনশিউরেন্স কমাতে হয়; এই রাজনীতি হলো ইকোনমিক গ্রোথের জন্য গ্রিন লেভিস হ্রাস ও পরিবেশ রক্ষার খরচ কমানোর রাজনীতি, আজ ইংল্যান্ড এই পথে যাচ্ছে, কাল গোটা ইউরোপ যাবে…