প্রতিবেশী ইউক্রেনের নেটোতে যোগদান ঠেকাতে ২৪শে ফেব্রুয়ারি এই সামরিক অভিযান শুরু করেছে রাশিয়া। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলছেন পশ্চিমাদের সামরিক জোট নেটো তার দেশের দোরগোড়ায় চলে আসবে এটি তিনি গ্রহণ করবেন না। যদিও পশ্চিমা শক্তিগুলো বলছে মিস্টার পুতিন আসলে ইউক্রেন দখল করে তার সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে চান। আর এই পাল্টাপাল্টি খেলায় অস্থির হয়ে উঠেছে বিশ্ব।
কিয়েভ-ভিত্তিক ইস্ট ইউরোপীয়ান ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউটের চেয়ারপার্সন ডঃ মৃদুলা ঘোষ বলছেন মি. পুতিন সাধারণ কোন যুদ্ধের সূচনা করেননি, বরং যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে গণ-অসন্তোষ সামাল দেয়া তার জন্য সহজ হবে না।
তিনি বলেন, “প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। এটা কমাতে হয়তো সামরিক শাসন জারি করতে পারেন। এটি হলে মানবাধিকারকে সংকুচিত করার সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু ধরুন মানুষ কথা বললো না, কিন্তু মানুষের পকেটে যখন টান পড়বে সেটা কিভাবে সামলানো হবে তা বলা মুশকিল। অদূর ভবিষ্যতে দু’দিক থেকে গণ-অসন্তোষের বড় ঢেউ আসলে, সেটা চাপা দেয়া যাবে না।”
পুতিনের ভবিষ্যৎ
গণ-অসন্তোষ যদি চাপা না দেয়া যায়, তাহলে পশ্চিমা দেশগুলো যেমনটা বলছে যে মিস্টার পুতিনকে ক্ষমতা থেকেও সরে যেতে হতে পারে- এই সম্ভাবনা কতটুকু?
“আমি তেমনটা মনে করি না। তিনি যেভাবেই হোক, সেখানকার একজন নির্বাচিত নেতা। তবে একটা চাপ তৈরি হবে। চাপ সৃষ্টি করে কিভাবে সমস্যার সমাধান হবে সেটাই এখন ভাবার বিষয়,” বলেন ডঃ মৃদুলা ঘোষ।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অবশ্য বলছেন চলমান যুদ্ধ বন্ধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তার সাথে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরাসরি আলোচনা। তবে মিস্টার পুতিন বলেছেন ইউক্রেনকে একটি নিরপেক্ষ দেশে পরিণত করার লক্ষ্য তার দেশ সাফল্যের সাথেই অর্জন করবে।
‘অলিগার্ক ও এস্টাব্লিশমেন্টের সমর্থন পাচ্ছেন পুতিন’
পশ্চিমা বিশ্ব অবশ্য বলছে যে মিস্টার পুতিন সাবেক সোভিয়েত সাম্রাজ্য ফিরে পেতে চান, যদিও সেটি কার্যত এখন আর সম্ভব নয় কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে স্বাধীন হওয়া কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যেই পশ্চিমা সামরিক জোট নেটোতে যোগ দিয়েছে।
মূলত রাশিয়ার সীমান্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের বাকী ছিলো শুধু ইউক্রেন। সে কারণেই দেশটিকে নেটোতে নিয়ে আসা ছিলো তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য।
আবার প্রতিবেশী এই দেশটির সাথে রুশদের সম্পর্কও বেশ ঘনিষ্ঠ। ইউক্রেনেও বহু মানুষ রুশ ভাষায় কথা বলেন। মিস্টার পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ তাই তাদের ক্ষুব্ধ করেছে।
অন্যদিকে সিরিয়াসহ নানা জায়গায় মিস্টার পুতিন পশ্চিমাদের সাথে টক্কর দিলেও এবার দেশকে তিনি সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছেন, যার জের ধরে নজিরবিহীন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে রাশিয়া।
বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন মিস্টার পুতিন যদি ইউক্রেনে সাফল্যও পান, তার পরেও দেশটির চার কোটিরও বেশি মানুষের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে তাকে এবং তার ঢেউ রাশিয়াতে আসলে, সেটিও তার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ বিলম্বিত হলে বা দেশটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর মধ্য থেকেও বিদ্রোহের আশংকাও তৈরি হতে পারে।
দিল্লিতে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ও ভারতের একজন সাবেক কূটনীতিক এস ডি মুনি বলছেন ইউক্রেন থেকে সুস্পষ্ট বিজয় না আনতে পারলে মিস্টার পুতিন কেমন পরিস্থিতিতে পড়েন সেটিই হবে দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, “যে খবরই আসুক একটা বিষয় নিশ্চিত যে পুতিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে রাশিয়াতে। কিন্তু আপনি জানেন যে রাশিয়ার সিস্টেমটাই এমন যেন তারা গণবিক্ষোভ দমন করতে পারে। এটা আগে বহুবার ঘটেছে। এখন পুতিন অলিগার্ক ও এস্টাব্লিশমেন্টের সমর্থন পাচ্ছেন। আমার মনে হয় পুতিনকে অবশ্যই ইউক্রেন থেকে একটি রেজাল্ট আনতে হবে।”
“তিনি যদি আসন্ন সপ্তাহগুলোতে কিছু ফল আনতে পারেন তাহলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে আনতে পারবেন। অন্যথায় তার রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক হুমকির মুখে পড়বে। এটি সত্যি যে রাশিয়াকে ইউক্রেনের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে। সেজন্য রাশিয়ান আর্মি দ্রুত প্রত্যাশিত সফল হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হলো পুতিনকে যুদ্ধের ময়দান থেকে সাফল্য এনে দেখাতে হবে।”
সাফল্য দেখাতে হবে পুতিনকে
মিস্টার পুতিন ২০০০ সালে ক্ষমতার আসার পর থেকে সবসময়ই অলিগার্ক বা রাশিয়ান ধনকুবেরদের সমর্থন পাচ্ছেন।
২০১৮ সালে ছয় বছর মেয়াদের জন্য পুন:নির্বাচিত হওয়া মিস্টার পুতিনের মেয়াদ ২০২৪ সালে শেষ হলেও সাংবিধানিক সংস্কারের কারণে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত তার দেশটির ক্ষমতায় থাকার সুযোগ আছে।
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পশ্চিমারা তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের হুমকিও দিচ্ছেন, যার ভিত্তিগুলোর একটি হচ্ছে- রাশিয়াতেই তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা শক্ত বিরোধিতা।
আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর থেকে রাশিয়ার বহু বিত্তবান মানুষ ইউরোপ আমেরিকার সাথে নানাভাবে যোগ সূত্র তৈরি করেছে।
ফুটবল ক্লাব থেকে শুরু করে নানা কিছুতে বড় বড় বিনিয়োগও আছে তাদের। এখন এগুলোর কী হবে তা নিয়েও অনেকে উদ্বিগ্ন। আবার অনেকে পশ্চিমা দেশগুলোতে হরদম আসা যাওয়াতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেটিও ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্ধ হয়ে যাবে।
প্রফেসর এস ডি মুনি বলছেন রাশিয়া সবকিছু বিবেচনা করেছে সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
“এটিই রাশিয়া বা পুতিনের জন্য প্রথম নিষেধাজ্ঞা নয়। তবে এবারের নিষেধাজ্ঞা অনেক বেশি ব্যাপক ও মারাত্মক। আমি জানি সেখানে অনেক অসন্তোষ আছে। ইউক্রেনের রুশভাষীরাও খুশী না। কিন্তু সংস্কৃতির বিষয়টি যতটা আলোচনায় থাকে সামরিক হিসেব-নিকেশে ততটা গুরুত্ব পায় না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো মাঠের বাস্তবতা।”
‘রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে ঝুঁকি নিয়েছেন পুতিন’
বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলছেন মিস্টার পুতিন যে ব্যাখ্যাই দেন না কেন, কোন কিছুর জন্যই যুদ্ধ অপরিহার্য ছিলো না। ফলে এর মূল্য তাকে দিতে হবে, কিন্তু সেটা কেমন হয় তা দেখার জন্য যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
“অর্থনীতিতে শক্তিশালী না হলে সামরিক শক্তি দিয়ে যে কিছু করা যায় না তা সোভিয়েত আমলেই প্রমাণ হয়েছে। সেজন্য সোভিয়েত ভেঙ্গে গেছে। এখনো যদি মনে করেন যে সামরিকভাবেই টেকসই কিছু করবেন তা তো হবে না। তার এখনকার আক্রমণের মূল্য অনেক বেশি। যদি কোন কারণে হেরে যান, বা পরাজয় না হলেও যদি আলোচনার মাধ্যমে বের হয়ে আসতে হয়, তাহলে তার রেজিম টিকিয়ে রাখাই কঠিন হবে। তার নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতও শঙ্কাপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা তো থাকছেই,” বলেন তিনি।
তবে অনেকেই মনে করেন যুদ্ধে ইউক্রেনের কী হলো তা দেখার পাশাপাশি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি কোন দিকে যায় আর মানুষের ওপর তার চাপ কেমন পড়ে সেটাও দেখার বিষয়।
কারণ অর্থনীতি খারাপ হলে ক্ষোভ আরও বাড়বে। আবার ইউক্রেনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিলেও সামরিক ব্যয় অনেক বাড়বে।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অসন্তোষ মাথায় নিয়েই যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। আর এর মূল লক্ষ্য হিসেবে অনেকে বলছেন যে পশ্চিমা আধিপত্যের অবসান চায় রাশিয়া।
কিন্তু সেটি করতে গিয়ে নিজের দেশ ও নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি।
যেমনটি বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন।
তিনি মনে করেন যুদ্ধকে একটি কৌশল হিসেবে নিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। তার এ কৌশল পুরো বিশ্বকেই একটি নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের দিকে নিয়ে যাবে।
“শুধু ইউক্রেনের জন্য নয়, এটা পুরো পশ্চিমা বিশ্বের জন্য পুতিনের সতর্কবার্তা যে আমার লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সরে আসবো না। অবশ্যই এর ব্যাপক গুরুত্ব আছে। এটা কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ নয়। কারণ এটা যুদ্ধ গড়িয়েছে। এখানে রাশিয়ার চাওয়া- ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঠেকানো। এই যুদ্ধে শুধু রাশিয়া না, বরং পুরো বিশ্বে একটা নতুন ধরনের মেরুকরণ তৈরি হবে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন গণতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের কথা। কিন্তু এটা শুধু এটুকুই নয়। এর বাইরেও এর গুরুত্ব আছে, সেটা যেন ভুলে না যাই,” বলেন তিনি।
অর্থাৎ এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে আমেরিকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।
গত কয়েক বছরে নানা জায়গায় মার্কিন-স্বার্থে বাধা দিয়ে সেই কর্তৃত্বে ক্ষত তৈরির চেষ্টাও করেছে রাশিয়া-চীন-ইরান। সে প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া বা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে পশ্চিমা বিশ্ব ঠেকিয়ে দিতে পারলে বৈশ্বিক রাজনীতিতেও বড় পরিবর্তন আসবে।
আর সে কারণেই ইউক্রেনের সাফল্য অনেকটাই অপরিহার্য মিস্টার পুতিনের জন্য।
কিন্তু সেই সাফল্য শেষ পর্যন্ত না এলে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে তা কিভাবে তিনি সামাল দিবেন সেটিই হবে তখন দেখার বিষয়।
প্রতিবেশী ইউক্রেনের নেটোতে যোগদান ঠেকাতে ২৪শে ফেব্রুয়ারি এই সামরিক অভিযান শুরু করেছে রাশিয়া। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলছেন পশ্চিমাদের সামরিক জোট নেটো তার দেশের দোরগোড়ায় চলে আসবে এটি তিনি গ্রহণ করবেন না। যদিও পশ্চিমা শক্তিগুলো বলছে মিস্টার পুতিন আসলে ইউক্রেন দখল করে তার সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে চান। আর এই পাল্টাপাল্টি খেলায় অস্থির হয়ে উঠেছে বিশ্ব।
কিয়েভ-ভিত্তিক ইস্ট ইউরোপীয়ান ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউটের চেয়ারপার্সন ডঃ মৃদুলা ঘোষ বলছেন মি. পুতিন সাধারণ কোন যুদ্ধের সূচনা করেননি, বরং যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে গণ-অসন্তোষ সামাল দেয়া তার জন্য সহজ হবে না।
তিনি বলেন, “প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। এটা কমাতে হয়তো সামরিক শাসন জারি করতে পারেন। এটি হলে মানবাধিকারকে সংকুচিত করার সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু ধরুন মানুষ কথা বললো না, কিন্তু মানুষের পকেটে যখন টান পড়বে সেটা কিভাবে সামলানো হবে তা বলা মুশকিল। অদূর ভবিষ্যতে দু’দিক থেকে গণ-অসন্তোষের বড় ঢেউ আসলে, সেটা চাপা দেয়া যাবে না।”
পুতিনের ভবিষ্যৎ
গণ-অসন্তোষ যদি চাপা না দেয়া যায়, তাহলে পশ্চিমা দেশগুলো যেমনটা বলছে যে মিস্টার পুতিনকে ক্ষমতা থেকেও সরে যেতে হতে পারে- এই সম্ভাবনা কতটুকু?
“আমি তেমনটা মনে করি না। তিনি যেভাবেই হোক, সেখানকার একজন নির্বাচিত নেতা। তবে একটা চাপ তৈরি হবে। চাপ সৃষ্টি করে কিভাবে সমস্যার সমাধান হবে সেটাই এখন ভাবার বিষয়,” বলেন ডঃ মৃদুলা ঘোষ।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অবশ্য বলছেন চলমান যুদ্ধ বন্ধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তার সাথে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরাসরি আলোচনা। তবে মিস্টার পুতিন বলেছেন ইউক্রেনকে একটি নিরপেক্ষ দেশে পরিণত করার লক্ষ্য তার দেশ সাফল্যের সাথেই অর্জন করবে।
‘অলিগার্ক ও এস্টাব্লিশমেন্টের সমর্থন পাচ্ছেন পুতিন’
পশ্চিমা বিশ্ব অবশ্য বলছে যে মিস্টার পুতিন সাবেক সোভিয়েত সাম্রাজ্য ফিরে পেতে চান, যদিও সেটি কার্যত এখন আর সম্ভব নয় কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে স্বাধীন হওয়া কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যেই পশ্চিমা সামরিক জোট নেটোতে যোগ দিয়েছে।
মূলত রাশিয়ার সীমান্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের বাকী ছিলো শুধু ইউক্রেন। সে কারণেই দেশটিকে নেটোতে নিয়ে আসা ছিলো তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য।
আবার প্রতিবেশী এই দেশটির সাথে রুশদের সম্পর্কও বেশ ঘনিষ্ঠ। ইউক্রেনেও বহু মানুষ রুশ ভাষায় কথা বলেন। মিস্টার পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ তাই তাদের ক্ষুব্ধ করেছে।
অন্যদিকে সিরিয়াসহ নানা জায়গায় মিস্টার পুতিন পশ্চিমাদের সাথে টক্কর দিলেও এবার দেশকে তিনি সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছেন, যার জের ধরে নজিরবিহীন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে রাশিয়া।
বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন মিস্টার পুতিন যদি ইউক্রেনে সাফল্যও পান, তার পরেও দেশটির চার কোটিরও বেশি মানুষের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে তাকে এবং তার ঢেউ রাশিয়াতে আসলে, সেটিও তার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ বিলম্বিত হলে বা দেশটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর মধ্য থেকেও বিদ্রোহের আশংকাও তৈরি হতে পারে।
দিল্লিতে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ও ভারতের একজন সাবেক কূটনীতিক এস ডি মুনি বলছেন ইউক্রেন থেকে সুস্পষ্ট বিজয় না আনতে পারলে মিস্টার পুতিন কেমন পরিস্থিতিতে পড়েন সেটিই হবে দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, “যে খবরই আসুক একটা বিষয় নিশ্চিত যে পুতিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে রাশিয়াতে। কিন্তু আপনি জানেন যে রাশিয়ার সিস্টেমটাই এমন যেন তারা গণবিক্ষোভ দমন করতে পারে। এটা আগে বহুবার ঘটেছে। এখন পুতিন অলিগার্ক ও এস্টাব্লিশমেন্টের সমর্থন পাচ্ছেন। আমার মনে হয় পুতিনকে অবশ্যই ইউক্রেন থেকে একটি রেজাল্ট আনতে হবে।”
“তিনি যদি আসন্ন সপ্তাহগুলোতে কিছু ফল আনতে পারেন তাহলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে আনতে পারবেন। অন্যথায় তার রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক হুমকির মুখে পড়বে। এটি সত্যি যে রাশিয়াকে ইউক্রেনের ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে। সেজন্য রাশিয়ান আর্মি দ্রুত প্রত্যাশিত সফল হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হলো পুতিনকে যুদ্ধের ময়দান থেকে সাফল্য এনে দেখাতে হবে।”
সাফল্য দেখাতে হবে পুতিনকে
মিস্টার পুতিন ২০০০ সালে ক্ষমতার আসার পর থেকে সবসময়ই অলিগার্ক বা রাশিয়ান ধনকুবেরদের সমর্থন পাচ্ছেন।
২০১৮ সালে ছয় বছর মেয়াদের জন্য পুন:নির্বাচিত হওয়া মিস্টার পুতিনের মেয়াদ ২০২৪ সালে শেষ হলেও সাংবিধানিক সংস্কারের কারণে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত তার দেশটির ক্ষমতায় থাকার সুযোগ আছে।
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পশ্চিমারা তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের হুমকিও দিচ্ছেন, যার ভিত্তিগুলোর একটি হচ্ছে- রাশিয়াতেই তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা শক্ত বিরোধিতা।
আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর থেকে রাশিয়ার বহু বিত্তবান মানুষ ইউরোপ আমেরিকার সাথে নানাভাবে যোগ সূত্র তৈরি করেছে।
ফুটবল ক্লাব থেকে শুরু করে নানা কিছুতে বড় বড় বিনিয়োগও আছে তাদের। এখন এগুলোর কী হবে তা নিয়েও অনেকে উদ্বিগ্ন। আবার অনেকে পশ্চিমা দেশগুলোতে হরদম আসা যাওয়াতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেটিও ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্ধ হয়ে যাবে।
প্রফেসর এস ডি মুনি বলছেন রাশিয়া সবকিছু বিবেচনা করেছে সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
“এটিই রাশিয়া বা পুতিনের জন্য প্রথম নিষেধাজ্ঞা নয়। তবে এবারের নিষেধাজ্ঞা অনেক বেশি ব্যাপক ও মারাত্মক। আমি জানি সেখানে অনেক অসন্তোষ আছে। ইউক্রেনের রুশভাষীরাও খুশী না। কিন্তু সংস্কৃতির বিষয়টি যতটা আলোচনায় থাকে সামরিক হিসেব-নিকেশে ততটা গুরুত্ব পায় না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো মাঠের বাস্তবতা।”
‘রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে ঝুঁকি নিয়েছেন পুতিন’
বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলছেন মিস্টার পুতিন যে ব্যাখ্যাই দেন না কেন, কোন কিছুর জন্যই যুদ্ধ অপরিহার্য ছিলো না। ফলে এর মূল্য তাকে দিতে হবে, কিন্তু সেটা কেমন হয় তা দেখার জন্য যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
“অর্থনীতিতে শক্তিশালী না হলে সামরিক শক্তি দিয়ে যে কিছু করা যায় না তা সোভিয়েত আমলেই প্রমাণ হয়েছে। সেজন্য সোভিয়েত ভেঙ্গে গেছে। এখনো যদি মনে করেন যে সামরিকভাবেই টেকসই কিছু করবেন তা তো হবে না। তার এখনকার আক্রমণের মূল্য অনেক বেশি। যদি কোন কারণে হেরে যান, বা পরাজয় না হলেও যদি আলোচনার মাধ্যমে বের হয়ে আসতে হয়, তাহলে তার রেজিম টিকিয়ে রাখাই কঠিন হবে। তার নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতও শঙ্কাপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা তো থাকছেই,” বলেন তিনি।
তবে অনেকেই মনে করেন যুদ্ধে ইউক্রেনের কী হলো তা দেখার পাশাপাশি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি কোন দিকে যায় আর মানুষের ওপর তার চাপ কেমন পড়ে সেটাও দেখার বিষয়।
কারণ অর্থনীতি খারাপ হলে ক্ষোভ আরও বাড়বে। আবার ইউক্রেনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিলেও সামরিক ব্যয় অনেক বাড়বে।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অসন্তোষ মাথায় নিয়েই যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। আর এর মূল লক্ষ্য হিসেবে অনেকে বলছেন যে পশ্চিমা আধিপত্যের অবসান চায় রাশিয়া।
কিন্তু সেটি করতে গিয়ে নিজের দেশ ও নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি।
যেমনটি বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন।
তিনি মনে করেন যুদ্ধকে একটি কৌশল হিসেবে নিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। তার এ কৌশল পুরো বিশ্বকেই একটি নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের দিকে নিয়ে যাবে।
“শুধু ইউক্রেনের জন্য নয়, এটা পুরো পশ্চিমা বিশ্বের জন্য পুতিনের সতর্কবার্তা যে আমার লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সরে আসবো না। অবশ্যই এর ব্যাপক গুরুত্ব আছে। এটা কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ নয়। কারণ এটা যুদ্ধ গড়িয়েছে। এখানে রাশিয়ার চাওয়া- ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঠেকানো। এই যুদ্ধে শুধু রাশিয়া না, বরং পুরো বিশ্বে একটা নতুন ধরনের মেরুকরণ তৈরি হবে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন গণতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের কথা। কিন্তু এটা শুধু এটুকুই নয়। এর বাইরেও এর গুরুত্ব আছে, সেটা যেন ভুলে না যাই,” বলেন তিনি।
অর্থাৎ এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে আমেরিকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।
গত কয়েক বছরে নানা জায়গায় মার্কিন-স্বার্থে বাধা দিয়ে সেই কর্তৃত্বে ক্ষত তৈরির চেষ্টাও করেছে রাশিয়া-চীন-ইরান। সে প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া বা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে পশ্চিমা বিশ্ব ঠেকিয়ে দিতে পারলে বৈশ্বিক রাজনীতিতেও বড় পরিবর্তন আসবে।
আর সে কারণেই ইউক্রেনের সাফল্য অনেকটাই অপরিহার্য মিস্টার পুতিনের জন্য।
কিন্তু সেই সাফল্য শেষ পর্যন্ত না এলে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে তা কিভাবে তিনি সামাল দিবেন সেটিই হবে তখন দেখার বিষয়।