উনিশ শ নব্বই-এর দশকে সদ্য স্বাধীন দেশ কাজাখস্তানে গড়ে তোলা হয় নতুন এক রাজধানী। এই নির্মাণ কাজ ছিল বিশাল এক প্রকল্প এবং এর পেছনে ছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট নূরসুলতান নাজারবায়েফ, যিনি ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। আরো অনেক পরে, ২০১৯ সালে, তার নামেই এই রাজধানীর নামকরণ করা হয়- নূরসুলতান।
নতুন নাম ঘোষণা করার আগেই এই শহরে প্রেসিডেন্ট নাজারবায়েফের হাতের ছাপ দিয়ে তৈরি একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে যা সোনা দিয়ে তৈরি। তার অনেক ভাস্কর্যও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শহরের বিভিন্ন স্থানে।
আজকের নূরসুলতান শহরে চোখে পড়ে চকচকে, ঝকঝকে সুরম্য অট্টালিকা। রয়েছে সুদৃশ্য বহু স্মৃতিস্তম্ভ। পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্যে যেসব প্রচারণা চালানো হয়, তার কেন্দ্রেও রয়েছে এসব দর্শনীয় ভবন ও স্মৃতিস্তম্ভের কথা।
কিন্তু নব্বই-এর দশকের শুরুতে ছোট্ট এই শহরটি দেখতে ছিল একেবারে অন্যরকম।
সেসময় কাজাখস্তানে কাজ করতেন মার্কিন সাংবাদিক স্টিভ লিভিন। তিনি বলেন শহরটির অবস্থা খুবই খারাপ ছিল- বৈচিত্রহীন, ভগ্নপ্রায়।
“খুব কম জায়গাতেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল। শহরে কোনো ধরনের অবকাঠামো ছিল না। এটি আন্তর্জাতিক কোনো শহরের ধারে কাছেও ছিল না,” বলেন তিনি।
সেসময় কাজাখস্তানের যে শহরটি রাজধানী ছিল তার নাম আলমাটি। বর্তমান রাজধানী নূরসুলতান থেকে এটি প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরে।
দেশটির একেবারে দক্ষিণ-পূবের ছোট্ট এই আলমাটি শহর অবস্থিত তিয়েনশান পর্বতের পাদদেশে। এই শহরটি এখনও কাজাখস্তানের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
স্টিভ লিভিন কাজ করতেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের জন্য। কাজাখস্তানে তখনও তার বেশি দিন হয়নি। তার আগেই রাজধানী অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কথাবার্তা হচ্ছিল। তিনি বলেন যেখানে নতুন রাজধানী গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল তার কথা খুব লোকই জানতো। সেসময় ওই শহরটির নাম ছিল একমোলা।
“অনেকেই এই শহরটির কথা জানতো না। ‘কী? এটা কোথায়?’- শোনার পর সবাই এভাবেই বলতো। মনে হচ্ছিল এই পরিকল্পনাকে কেউ গুরুত্বের সঙ্গে নেয় নি।”
নতুন রাজধানী গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল দেশটির প্রেসিডেন্ট নূরসুলতান নাজারবায়েফের।।
“যখন আপনি কাজাখস্তানের মতো একটি দেশের কথা বলবেন তখন মনে রাখতে হবে যে দেশটির সবকিছুই তার প্রেসিডেন্টকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে।”
মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে সেসময় একনায়ক নেতারাই নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী, তাদের একজন এই নাজারবায়েফ।
তিনি ছিলেন ইস্পাত কারখানার শ্রমিক, যিনি উঠে আসেন কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পদে। তিনিই ছিলেন কাজাখস্তানে সর্বশেষ সোভিয়েত নেতা। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর তিনিই যে নতুন এই দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট হবেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না।
সাংবাদিক স্টিভ লিভিন মনে করেন নাজারবায়েফ যে নতুন রাজধানী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এর পেছনে তার অনেক ব্যক্তিগত কারণও ছিল।
“নাজারবায়েফের ছিল পিটার দ্যা গ্রেট কমপ্লেক্স। পিটার দ্যা গ্রেট রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে সরিয়ে নিয়েছিলেন। নাজারবায়েফ সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি কাজাখস্তানের সম্রাট এবং তার নিজেরও একটা রাজধানী থাকবে। সম্ভবত এটাই ছিল মূল কারণ।”
নাজারবায়েফ তার নতুন রাজধানীর জন্য একমোলা শহরটি বেছে নিয়েছিলেন, কাজাখ ভাষায় এই নামের অর্থ- সাদা কবর। এটি ছিল দেশের কেন্দ্রে এবং রাশিয়ার কাছে। তিনি ভেবেছিলেন যে এর ফলে রাশিয়া হয়তো সেখানে ফিরে যেতে উৎসাহিত হবে না। এটি ছিল শুষ্ক এবং অনুর্বর এক বিস্তৃত এলাকা। কাজাখস্তানের অন্যান্য শহরের মতো এরও ছিল ভগ্নদশা।
স্টিভ লিভিন ১৯৯৭ সালের শীতকালে প্রথমবারের মতো সেখানে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করছিলেন।
“আমরা ট্রেনে করে গিয়েছিলাম। ২৪ ঘণ্টার এক ভ্রমণ। এটা ছিল ডিসেম্বর মাস। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। তাপমাত্রা ছিল শূন্যেরও দশ থেকে কুড়ি ডিগ্রি নিচে। আর গ্রীষ্মকালে ছিল প্রচণ্ড গরম। মশার আকৃতি ছিল বিমানের সমান।”
সাংবাদিক স্টিভ বলেন যে তারা ওই শহরের সাধারণ লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন যা তাদের চোখ খুলে দিয়েছিল। যেহেতু এই জায়গাটির প্রতি দীর্ঘ সময় ধরে নজর দেওয়া হয়নি, সেকারণে শহরে যেসব মৌলিক জিনিস থাকার কথা সেসব ছিল না। হিটিং ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না।
“আমি একটা বাড়িতে গিয়েছিলাম, সেখানে বয়স্ক এক দম্পতি ছিল। একজন বৃদ্ধ মহিলা কম্বল দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে বসেছিলেন। তার পা দুটো ছিল স্টোভের ওপর। এই শহরটা রাজধানী হবে- আমাদের একথা শুনে তারা বললেন, এটা কীভাবে সম্ভব! আপনারা দেখছেন আমরা এখানে কীভাবে বসবাস করছি, এটা কীভাবে রাজধানী হবে!”
তবে কাজাখ সরকার তার সিদ্ধান্তে ছিল বদ্ধপরিকর। এর ছয় মাস পর ১৯৯৮ সালে কাজাখস্তানের নতুন রাজধানীর নামকরণ করা হলো আস্তানা। কাজাখ ভাষায় এই শব্দটির অর্থ রাজধানী।
“ওই শহরে ছিল দু’পাশে বৃক্ষরাজি শোভিত প্রশস্ত সড়ক। এরকম একটি সড়ক দিয়ে একটি যানবহরে প্রেসিডেন্ট নাজারবায়েফকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যাওয়া হবে শহরের প্রধান চত্বরে, যেখানে তিনি নতুন রাজধানীর কথা ঘোষণা করবেন।”
এজন্য শহরের ভগ্নপ্রায় বাড়িঘরগুলোকে ওয়ালপেপার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।
“দুই/তিন মাইল দীর্ঘ রাস্তার দুপাশে সব ভবনগুলোর সামনের দিকে এবং উভয় পাশে, যে পাশগুলো দেখা যায়, সেখানে বড় বড় কাপড় বা ওয়ালপেপারের মতো জিনিস লাগানো হলো। এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যখন দুপাশে তাকাবেন, এই ভবনগুলোকে চিত্তাকর্ষক বলে মনে হবে। কিন্তু পেছন দিকে তাকালে দেখা যাবে সেই পুরনো ভবন, আকর্ষণহীন, ভেঙে পড়ে যাচ্ছে,” বলেন সাংবাদিক স্টিভ লিভিন।
এই রাজধানীতে নতুন নতুন ভবন ও অবকাঠামো তৈরি করতে সময় লেগেছে ১০ বছর। খরচ হয়েছে শত শত কোটি ডলার। সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আলমাটিতে নিজেদের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি এবং দূতাবাসকে উৎসাহিত করতে হয়েছে নতুন রাজধানীতে চলে যাওয়ার ব্যাপারে।
নতুন এই রাজধানী দেশটির অনেক আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে। গড়ে ওঠে অত্যাধুনিক সব ভবন। বিশ্বের বড় বড় সব স্থপতিরা এসব ভবনের নকশা তৈরি করেছেন।
স্টিভ লিভিন বলেন, “আজকের রাজধানী এক জমকালো শহর। এখানে আছে প্রথম শ্রেণির রেস্তোরাঁ, প্রথম শ্রেণির হোটেল। এগুলো আকারেও বেশ বড়। কোন দেশের প্রচুর তেল ও অর্থ সম্পদ থাকলে এরকমই হয়।”
এর মধ্যে কিছু লোক প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হয়। তাদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট এবং তার পরিবারের সদস্যরাও রয়েছেন।
বেশ কয়েকটি নির্বাচনে নূরসুলতান নাজারবায়েফ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বেশিরভাগ কাজাখ ধরে নিয়েছিলেন যে তিনি আজীবন প্রেসিডেন্ট থেকে যাবেন।
কিন্তু ২০১৯ সালে তিনি তার পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
সেসময় তিনি তার নামের অনুসরণে রাজধানীর নামকরণ করেন- নূরসুলতান।
মূল – https://www.bbc.com/bengali/news-61634226