আগে ঢাকার মতো প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা পৃথিবীর কোথাও ছিল না। কিন্তু এরই মধ্যে সেই নিষ্কাশন ব্যবস্থা মরে গেছে। ভরাট করা হয়েছে মহামূল্যবান জলাশয়, পুকুর ও খালবিল। ফলে প্রিয় এই রাজধানী শহরটি মারাত্মকভাবে বন্যাকবলিত হওয়ার আশঙ্কায় আছে। এতে এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে নতুন করে বন্যার ঝুঁকিতে পড়েছেন দেড় কোটি মানুষ, যা দেশের জনসংখ্যার ৯ শতাংশ। প্লাবনভূমি ও নদী তীরে বসতি এবং অবকাঠামো বেড়ে যাওয়ায় এ ঝুঁকি আরো বাড়ছে। ফলে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে বন্যার ভয়াবহতা সামনের দিনগুলোতে আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে প্লাবনভূমি রক্ষা করতে পারলে এ অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও ঢাকা রক্ষা পেতে পারে বলে মত দিয়েছেন গবেষকরা।
সম্প্রতি ‘বাংলাদেশের নদী এলাকায় মানব উপস্থিতি ও বন্যার ঝুঁকির গতিবিধি ‘ বিভিন্ন সময়ের উপগ্রহের ছবির একটি মূল্যায়ন’ শিরোনামের গবেষণা করে জিওকার্টো ইন্টারন্যাশনাল। যা একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশ পেয়েছে। নিবন্ধটির গবেষকদের একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক।
এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে আট কোটি ৭০ লাখ (প্রায় পৌনে ৯ কোটি) মানুষ সরাসরি বন্যাকবলিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এসব মানুষ বাস করছেন দেশের ছোট-বড় নদীগুলোর দুই কিলোমিটারের মধ্যে। এ ছাড়াও বিভিন্ন কারণে মানুষের জন্য বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে। যেমন, নদীর ১-২ কিলোমিটার তীরবর্তী বনাঞ্চল ৯১.৯৮ শতাংশ সংকুচিত হয়ে গেছে। তৃণভূমি ৬ শতাংশ ও অনুর্বর ভূমি কমেছে ২৭.৯২ শতাংশ। এ ছাড়াও প্লাবনভূমি আর নদী অববাহিকায় বসতি ও স্থাপনা নির্মাণ বেড়েছে ১১ শতাংশের বেশি।
এদিকে, মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার আর্থ অবজারভেটরির এক প্রতিবেদন বলছে, ১৯৮৮ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৫৭ লাখ। কিন্তু ২০২২ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ২০ লাখে। জনসংখ্যার এই ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি এখন ঢাকা। যে কারণে এখানকার বহু মানুষকে বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে বাস করতে হচ্ছে।
ন্যাচার সাময়িকীর এক বিশ্লেষণ বলছে, ঢাকার চারপাশেই নদী। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা, পশ্চিমে তুরাগ, উত্তরে টঙ্গীখাল ও পূর্বে বালু নদী। ২০০০ সাল থেকে বুড়িগঙ্গা ও বালু নদীর তীরে জনবসতি বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৮ সালের বন্যায় ডুবে গিয়েছিল ঢাকা। এতে দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। আর ১৯৯৮ সালের বন্যায় মারা যান ৯০০ জন। প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, উপগ্রহের মাধ্যমে তোলা রাতের ছবির পিক্সেলের আলো বিশ্লেষণ করে দেশের কোথায় কোথায় মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে, সে সম্পর্কে ধারণা নেওয়া হয়েছে। ছবিতে কোথাও কোথাও আলোর উজ্জ্বলতা বেড়েছে।
আলোর উজ্জ্বলতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গবেষক দলের নেতা ও অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আশরাফ দেওয়ান বলেন, ‘আমাদের নগর কিংবা গ্রামীণ অঞ্চলে আলো থাকে। যেসব অঞ্চলে শিল্পকারখানা আছে, সেখানেও আলো থাকে। নাসার বিশেষায়িত একটি উপগ্রহ আছে, যেটা কেবল রাত্রিকালীন আলোর তথ্য চিত্রায়ন করে। অর্থাৎ কোথায় আলো কমেছে কিংবা কোথায় বেড়েছে, তা ধারণ করতে পারে এ উপগ্রহ। এ রকম উপগ্রহ দিয়ে ১৯৯২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরের ডেটা নিয়েছি আমরা। কিন্তু এ গবেষণায় ২০০০-২০১৮ সালের তথ্য ব্যবহার করেছি।’
উদহারণ দিয়ে ড. আশরাফ বলেন, যেমন সূর্যের আলোতে সবকিছু দেখা যায়, কিন্তু রাতের আলোতে সবকিছু দেখা সম্ভব হবে না। কেবল কোথায় আলো আছে, তা-ই দেখা যায়। রাতের সেই আলো ধারণ করে তা দিয়ে ছবি তৈরি করে উপগ্রহ। সেই আলো কোথায় বাড়ছে, কোথায় কমছে, আমাদের দেশের প্লাবনভূমিতে আলোর উজ্জ্বলতা কতটা বেড়েছে, গবেষণায় তা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। গবেষণায় রাতের আলোর পাশাপাশি ভৌগোলিক তথ্য, ভূমির ব্যবহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জনসংখ্যার বণ্টন ও বিদ্যুতের সরবরাহ নিয়েও তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপকের মতে, প্লাবনভূমি হচ্ছে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে নদীর পানি আসে। বর্ষায় পানি আসে, শীত এলে তা নেমে যায়। প্লাবনভূমি একেবারে সমতল ভূমি। সেখানে ভূমির তারতম্য খুবই কম। যে কারণে এই ভূমিতে উন্নয়ন খরচও কম পাহাড়ি এলাকার তুলনায়। সেখানে নগর কিংবা শিল্প-কারখানা তৈরি করাও সহজ। যেমন পার্বত্য অঞ্চলে একটি সড়ক বানাতে যে অর্থ খরচ হবে, প্লাবনভূমিতে তা লাগবে না। আর আমাদের দেশের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ প্লাবনভূমি, যা নদ-নদীর পলিমাটি দিয়ে তৈরি।
আর এ কারণে প্লাবনভূমিতে মানুষের কর্মকা- বিশ্লেষণ করে এ বন্যার ঝুঁকি নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান এ গবেষক। তিনি বলেন, ‘এসব ভূমিতে যখন নগরায়ণ ও কলকারখানা হয়ে যাবে, তখন সেখানে এমনিতেই আলো থাকতে হবে। গেল ১৯ বছরে এসব ভূমিতে কী পরিমাণ নগরায়ণ, কলকারখানা ও বসতবাড়ি হয়েছে, তাই আমরা দেখেছি গবেষণায়। এভাবে আমরা বন্যার ঝুঁকি নির্ধারণ করেছি।’
বন্যার ঝুঁকি কেন বেড়েছে তার ব্যাখ্যা দিয়ে এই গবেষক আরো বলেন, প্লাবনভূমি কমে গেলে বন্যার পানি কোথায় যাবে? তখন তা মানুষের বসতবাড়ি থেকে শুরু করে অবকাঠামোগুলো ডুবিয়ে দেবে। রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
গবেষণা অনুসারে, নওগাঁ, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও চট্টগ্রামে বন্যার ঝুঁকি রয়েছে। আর ঢাকা সবচেয়ে বেশি বন্যার ঝুঁকিতে। কারণ রাজধানীর জনসংখ্যার বড় একটি অংশ নদীর পাশে বসবাস করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, আগে পানি যেখানে ওঠার কথা উঠত, এখনো যেখানে ওঠার কথা সেখানে ওঠে। কিন্তু পানি যেখানে ওঠার কথা, এখন সেখানে মানুষ থাকে। কাজেই মানুষ থাকে বলে তাদের ক্ষতি হচ্ছে। আগে ঢাকার শ্যামলী পর্যন্ত পানি আসত, কল্যাণপুরে পানি আসত। এখন মানুষ থাকতে চাইলে পানি আটকাতে হবে। আর পানিকে আটকানো হয়েছে। আর ভিতরে যাতে পানি থাকতে না পারে, সে জন্য পাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাৎ পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বসবাস করতে চাইলে পানি সরিয়ে দিতে হবে। কাজেই পানিকে দোষ দিয়ে কিছু হবে না, পানির কাজ পানি করবেই। যেসব মানুষ প্লাবনভূমিতে আছে, তাদের সেখানে থাকতে হলে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা করতে হবে। কারণ বন্যার পানির সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক আছে। পানি জোর করে আটকে দিলে প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেক্ষেত্রে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।