সেই ছোট্টবেলায় মা-বাবার মুখে শেখানো বুলি, যখন আধো আধোভাবে উচ্চারণ করতাম তখন আমার সেই উচ্চারিত শব্দগুলোর সঙ্গে বাংলার নদী, মাঠ, ভাঁটফুল দুলে দুলে নৃত্য করত আর চুপি চুপি আমায় বলত, যখন তুমি শিশু থেকে ধীরে ধীরে কৈশোর ও যৌবনে পদার্পণ করবে, তখন তুমি এই ভাষার অতীত ইতিহাস জানতে পারবে। জানতে পারবে কীভাবে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বারসহ নাম না জানা অসংখ্য তরুণের বুকের তাজা রক্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই ভাষা।
শৈশব ছাড়িয়ে আজ আমি কৈশোরে। বাংলা ভাষার সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানার আগ্রহ আমাকে প্রতিনিয়ত দারুণভাবে তাড়িত করে। মাকে বললাম, মা, বাংলা ভাষার ইতিহাস জানতে চাই। জানতে চাই ৮ ফাল্গুনে কী হয়েছিল? কেনই-বা সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বাররা রক্ত ঝরিয়েছিল। হঠাৎ একদিন মা লাইব্রেরি থেকে আমার জন্য কিছু বই আনলেন আর বললেন, এগুলো পড়ো, তাহলে ভাষা নিয়ে তোমার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে। নিজের কৌতূহল মেটাতে পড়া শুরু করলাম এক-এক করে সব বই।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া সত্ত্বেও কলেজ ব্যাগে রেখে দিতাম বাংলা ভাষার বিভিন্ন কবিতা ও সাহিত্যের বই। সবাই যখন টিফিন চলাকালে হই-হুল্লোড় করে ক্যাম্পাস মাতিয়ে বেড়াত তখন আমি, চুপটি করে বেঞ্চে বসে বসে পড়তাম সালাম, বরকত, রফিকদের ইতিহাস। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত স্রোতস্বিনী নদীর মতো।
ভাষা নিয়ে লেখা কবিতা, গান, উপন্যাস আমাকে নতুনভাবে ভাবাতে শুরু করল। হঠাৎ একদিন আমার স্বপ্নে এলো ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সেই প্রথম নারী রওশান আরা বাচ্চু তার সহযোদ্ধা ড. শরিফা খাতুন সুরাইয়া ডলি সুফিয়া ইব্রাহিমসহ সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বাররা। তারা আমাকে সমস্বরে বলল, আমাদেরকে নিয়ে তোমার এই ভাবনা সত্যিই আনন্দের। কিন্তু দেখো, তুমি যেমনটি ভাবছো তেমনটি কি ভাবছে অন্যরা? দেখো সবাই ঘটা করে একুশে ফেব্রুয়ারি এলে নামমাত্র আমাদেরকে স্মরণ করে শোকসভা, গান, কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে। অথচ তাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় আচার-আচরণে বাঙালিয়ানার লেশমাত্র নেই। তাদের এই মেকি আচরণ আমাদের আত্মাকে দারুণভাবে ব্যথিত করে। আমরা ভেবেছিলাম, হয়তো আমাদের ফিনকি ঝরা তাজা রক্তে রঞ্জিত বাংলার মাটিতে এই মধুর ভাষার অমর্যাদা কেউ করবে না। অথচ দেখো, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষরা কীভাবে অসম্মান করছে এই ভাষার। দেখো, আজ শহিদ মিনারের স্তম্ভগুলো বেদনাসিক্ত। বধ্যভূমির জীবাশ্ম কঙ্কালে দেখো আজ নীরব আর্তনাদ। দেখো আজ এখনো পর্যন্ত সমগ্র দেশব্যাপী বাংলা ভাষার প্রচলন হলো না। এখনো অশুভ শক্তির ইশারায় রুদ্ধদ্বার ষড়যন্ত্র চলছে। আচ্ছা, তুমি কি পারবে আমাদের এই ভাষাকে রক্ষা করতে? পারবে কি আমাদের এই কথাগুলো পৌঁছে দিতে বাংলা ভাষাভাষী সব মানুষের কাছে? ভাষাশহিদদের এই আকুতি তাদের এই আর্তনাদ আমাকে দুঃখের অতলান্তিক সমুদ্রে ধাবিত করল। দৃপ্তকণ্ঠে শপথ নিলাম, আমৃত্যু বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার। রক্ষা করব সালামের মতো, বরকতের মতো, রফিকের মতো শফিউরের মতো, জব্বারের মতো।