ঢাকা ও চট্টগ্রামে গত ১৭ দিনে পাঁচ বিস্ফোরণ ও অগ্নি দুর্ঘটনায় ৩১ জনের প্রাণ গেল। এতে আহত-দগ্ধ হয়েছেন শতাধিক মানুষ। গ্যাস জমা এবং বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে এসব অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণগুলো হয়েছে। তবে ঠিক কোন কারণে এ গ্যাস জমলো ও শর্টসার্কিট হলো—তা প্রাথমিক তদন্তে জানা না গেলেও সবগুলো দুর্ঘটনায় ভবন রক্ষণাবেক্ষণে মালিকপক্ষের ও তদারকি কর্তৃপক্ষের ঘাটতি-অবহেলা এবং কিছুক্ষেত্রে ব্যবহারকারী বা বাসিন্দাদের অসচেতনতা ছিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গ্যাসের পাইপলাইনে ছিদ্র, পানির ট্যাংক বা সুয়্যারেজ লাইনে জমে থাকা গ্যাস, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট কিংবা এসি বিস্ফোরণ থেকে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ভবন নির্মাণে নীতিমালা না মানা, নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহার, ভবন এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস-সুয়্যারেজ লাইন রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় যত্ন এবং তদারকি না থাকার কারণে এ দুর্ঘটনা বাড়ছে। এখনই এ বিষয়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, বিস্ফোরক, নগরব্যবস্থাপনা ও কলকারখানা পরিদর্শনে নিয়োজিত সংস্থাগুলো কঠোর তদারকি না শুরু করলে এবং ভবনমালিক ও ব্যবহারকারীরা সচেতন না হলে আগামীতে এমন দুর্ঘটনা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীতে গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর সড়কের ২ নম্বর বাসার ১৪ তলা ভবনের ১০ তলায় আগুন লাগে। এতে দুই জন নিহত ও কয়েক জন আহত হয়। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে এ আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে মনে করে ফায়ার সার্ভিস। গত ৪ মার্চ শনিবার সকালে গুলশানের নিকেতনে ৬ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাসায় এক দুর্ঘটনায় একজন নিহত এবং আরেক জন গুরুতর দগ্ধ হন। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে এসি বিস্ফোরণ হয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
একই দিন বিকালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকায় সীমা অক্সিজেন কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাত জন মারা গেছেন। গুরুতর আহত হন ২৪ জন। গত ৫ মার্চ রবিবার রাজধানীতে সায়েন্সল্যাব এলাকায় শিরিন ম্যানসনের দুর্ঘটনায় তিন জন নিহত এবং ১৫ জন আহত হন। ভবনটির তৃতীয় তলায় একটি অফিসে জমা হওয়া গ্যাস থেকে এ বিস্ফোরণ ঘটে।
সর্বশেষ গত ৭ মার্চ মঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তানে সিদ্দিকবাজারের কুইন স্যানিটারি মার্কেটের সাত তলা ভবনে বিস্ফোরণে গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৮ জন মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন অনেকে। স্থানীয় কয়েকজন জানান, সিদ্দিকবাজারের ঐ ভবনে ক্যাফে কুইন নামক রেস্টুরেন্টের কিচেন রুম ছিল। তবে সেটি সাত আট বছর আগে বন্ধ হয়ে যায়। ঐ ভবনের মালিক রেজাউল রহমান রেস্টুরেন্টটি চালাতেন।
এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক দিনমনি শর্মা বলেন, আমরা প্রথমে এসে আগে গ্যাসের গন্ধ পেয়েছি। গ্যাসের লাইন বন্ধ করে কাজ শুরু করি। ভবনের ভেতরে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, এটা যেহেতু আবাসিক ভবন, সেহেতু গ্যাস লাইন থাকাই স্বাভাবিক। আর শুনেছি বিস্ফোরণ হওয়া রুমে আগে হোটেলের কিচেন রুম ছিল। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের কাজ চলছে। সেনাবাহিনীর বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট এসেছে। তারাও কাজ করছে। এখন পর্যন্ত বিস্ফোরক আলামত পাওয়া যায়নি।
তবে তিতাস গ্যাস লিমিটেডের পরিচালক (অপারেশন্স) মো. সেলিম মিয়া বলেন, গ্যাস থেকে কিংবা গ্যাসের ছিদ্র থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে, তা এখনো বলা যায় না। ভবনের ভেতরে একটি রাইজারের আলামত পাওয়া গেছে এবং এটি অক্ষত রয়েছে। এ ঘটনার পর তিন পর্যায়ে আমরা তদন্ত করেছি। গ্যাস ডিটেক্টর মেশিন দিয়ে গ্যাসের আলামত নেওয়ার চেষ্টা করছি। তদন্তের পর সব বিষয় বেরিয়ে আসবে। পরীক্ষানিরীক্ষা করা হচ্ছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালক হামিদুল রহমান বলেন, অফিস বন্ধ থাকায় এখন পর্যন্ত কাগজপত্র বের করে ভবনের বৈধতা-অবৈধতার বিষয়ে জানতে পারিনি। ক্যাফে কুইন স্যানিটারি মার্কেটটি আশির দশকে নির্মিত। আমরা ফাইল খুঁজে দেখার চেষ্টা করছি। ভবনটির চারতলা থেকে সাততলা অবৈধভাবে নির্মিত।
এর আগে ২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যায় মগবাজারের ওয়্যারলেস এলাকায় একটি তিন তলা ভবনের নিচতলায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। ঐ ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক আহত হন। ঐ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিল—মগবাজারের তিনতলা ভবনটির গ্যাসের সরবরাহ স্থায়ীভাবে বন্ধ করেনি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। অবৈধ সেই সংযোগ থেকে গ্যাস ব্যবহার করা হতো ভবনে। গ্যাস-সংযোগের পাইপলাইনের ছিদ্র থেকে গ্যাস বের হয়ে ভবনের নিচতলার শর্মা হাউজের ভেতরে জমা হয়। সেখান থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
এদিকে বাসা-বাড়ি, অফিস ও মার্কেটের ভবনগুলোর পানির ট্যাংক এবং সেপটিক ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সেগুলোতে বিপজ্জনক পরিমাণে গ্যাস জমে উঠছে বলে নগর সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো সূত্রে জানা গেছে। ঐ জমে থাকা গ্যাস থেকেই ঘটছে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। গত কয়েক বছর ধরে রাজধানীর পল্লবী, মিরপুর, কামরাঙ্গীরচর, বংশালসহ বিভিন্ন এলাকায় ভবনের ট্যাংকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির ট্যাংক এবং সেপটিক ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার না করলে তাতে নানা ধরনের টক্সিক গ্যাস জমা হয়। ঢাকনা বন্ধ থাকায় সেপটিক ট্যাংকের ভেতর অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড, সালফার ডাই অক্সাইডসহ সালফারের অন্যান্য গ্যাস, মিথেন, এমনকি বিষাক্ত কার্বন মোনোক্সাইড তৈরি হতে পারে। আর পানির ট্যাংকের ঢাকনা বন্ধ থাকায় তার ভেতরে মিথেন, এমোনিয়া, ক্লোরিন, হাইড্রোজেন গ্যাস জমা হতে পারে। আর সেটা দীর্ঘদিন বদ্ধ থাকার ফলে এসব গ্যাস ক্রমশ ঘন হতে থাকে। এরপর সেটা বিস্ফোরিত হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার একজন কর্মকর্তা জানান, ওয়াসার কয়েকটি জোনে শীতলক্ষ্যার পানি সরবরাহ করা হয়। গরমকালে শীতলক্ষ্যার পানিতে অ্যামোনিয়া বেড়ে যায়। যার কারণে পানির গন্ধ দূর ও জীবাণুমুক্ত করতে ক্লোরিন ব্যবহার করার মাধ্যমে পানি শোধন করে তারপর গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো হয়। তারপরেও পানিতে ক্লোরিনের গন্ধ সচরাচর সব এলাকাতেই পাওয়া যায়। পানির ট্যাংকির মধ্যে কী জমেছে এ বিষয়ে কেউই তদারকি করেন না।
বাড়ির পানির ট্যাংক পরিষ্কারের সার্ভিস দেয় ক্লিনডটকেয়ার নামক একটি প্রতিষ্ঠান। এর মালিক ইব্রাহীম খলিল বলেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এক্ষেত্রে শুধু বাড়ির মালিক নয়, মালিক-ভাড়াটিয়া সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি ঢাকাতে এমন অনেক ভবন রয়েছে যেখানে পানির ট্যাংকি অনেক দিন থেকেই পরিষ্কার করা হয় না। ভবন মালিকরা এটাকে বেশি গুরুত্বও দিতে চান না। পানির রিজার্ভারকে নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হলে বছরে রুটিন করে চার মাস পরপর পরিষ্কার করা উচিত।
ঢাকা ওয়াসার মুখপাত্র মোস্তফা তারেক বলেন, ভবনের ট্যাংকের পরিষ্কার-পরিচ্ছনতার দায়িত্ব ভবন মালিকের। তারপরও আমরা পরিষ্কারের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকি। সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাই।