২০২৩ সালের জানুয়ারিতে কলকাতার বইমেলায় কলাবতী মুদ্রা থেকে ‘শতবর্ষে রণজিৎ গুহ ও সাব-অল্টার্ন তত্ত্ব’ যখন প্রকাশিত হয়; তখন থেকে এ পর্যন্ত আর কেউ এ ধরনের গ্রন্থ প্রকাশ করেননি। তবে কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে আলোচিত ও নমস্য ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানমালা শুরু হয়েছিল। নিজের হাতে গড়া এবং অধুনা বিলুপ্ত ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’-এর জীবিত লেখকবৃন্দ, তার ছাত্রছাত্রীগণ, সুহৃদ ও সুশীল সমাজ চলতি বছরের ২৩ মে তার ১০০ বছর পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন।
রণজিৎ গুহ বাংলাদেশের ভূতপূর্ব বাখরগঞ্জ জেলার (বরিশাল) সিদ্ধকাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯ বঙ্গাব্দ, ২৩ মে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ। সিদ্ধকাটিতে তাদের পৈতৃক তালুকদারি ছিল ‘গুহ-বকশী’ নামে। রণজিতের পিতামহ ছিলেন একজন রাজস্ব কর্মকর্তা, এবং তার বাবা রাধিকা রঞ্জন গুহ একজন আইনজীবী ছিলেন, যিনি পরে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতির পদে উন্নীত হন। তার বড় ভাই দেব প্রসাদ গুহ পালি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন, যিনি বহু বছর ধরে বার্মার (মিয়ানমার) রেঙ্গুন (বর্তমানে ইয়াঙ্গুন) এবং ভারতের বেনারসে শিক্ষকতা করেন। রণজিৎ গ্রামের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তার পিতামহ তার শিক্ষার প্রতি বিশেষ যত্নশীল ছিলেন। গ্রামের স্কুল ছেড়ে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং ১৯৩৮ সালে মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে বৃত্তিসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নকালে রণজিৎ একজন মার্কসবাদী হয়ে ওঠেন এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। দলীয় কর্মকাণ্ড তার লেখাপড়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে; তার জীবন থেকে একটি বছর বাদ যায়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ পাশ করে ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজে রণজিৎ গুহকে ইতিহাস পড়াতেন প্রেরণাদায়ী ইতিহাসবিদ সুশোভন সরকার, যিনি সেই প্রতিষ্ঠানে অনেক তরুণ ইতিহাসবিদকে পথ দেখিয়েছিলেন। গুহ ‘A Rule of Property for Bengal’ (1963) গ্রন্থটি সুশোভন সরকারকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। কারণ তার মতে,‘stoked so many of my first doubts’। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে রণজিৎ গুহ যখন শিক্ষার্থী, সে সময় কলকাতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ক্ষতবিক্ষত। বিরূপ বিশ্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি তখন বামপন্থি আন্দোলনে সক্রিয়, মানবমুক্তির পথ অন্বেষণে উদ্দীপিত। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নকালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের ঐতিহাসিক উৎস সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়—সে সময় তিনি ইতিহাসবিদ সুশোভন সরকার দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। ভারতীয় পাঠকদের কাছে আন্তোনিও গ্রামসির সৃষ্টিকর্মকে পরিচিত করা প্রথম পণ্ডিতদের একজন হলেন সুশোভন সরকার। রণজিৎ গুহ তার সাহচর্যে এসে বাংলায় জমিদারিত্বের বিভিন্ন উদ্দীপক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন, যার ফলস্বরূপ ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় A Rule of Property for Bengal।
অন্যদিকে ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। এমএ পড়ার সময় রণজিৎ বাংলার ইতিহাসকে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেন।
১৯৪২ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত রণজিতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশেষত বামপন্থি আন্দোলনে গভীর সম্পৃক্ততা তাঁর জীবনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৪৭ সালে তিনি বোম্বে চলে যান, সেখানে People’s War জার্নালের জন্য কাজ করেন। একই বছরের ডিসেম্বরে World Federation of Democratic Youth-এর প্রতিনিধি হিসেবে প্যারিসে গমন করেন। ১৯৫৩ সালে কলকাতায় ফিরে এসে রণজিৎ কেশোরাম কটন মিল এবং ডক শ্রমিকদের মধ্যে অল্প সময়ের জন্য কাজ করেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে অতিবাহিত করার সময় গুহ ১৯৫৩ সালে শিক্ষকতা ও গবেষণার জগতে ফিরে আসেন। কিন্তু ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন হাঙ্গেরি আক্রমণ করলে গুহ কমিউনিস্ট পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৫৮-৫৯ সালে রণজিৎ গুহ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস বিভাগে যোগ দেন। সেখানে বিভাগীয় প্রধান ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যাপক ও মেন্টর সুশোভন সরকার। কিন্তু গুহ চাকরি ছেড়ে ১৯৫৯ সালে ইংল্যান্ডে চলে যান এবং পরবর্তী ২১ বছর সেখানে কাটিয়েছেন। ১৯৭০-৭১ সালে রণজিৎ গান্ধীকে নিয়ে গবেষণা করে বই লেখার উদ্দেশ্যে sabbatical leave নিয়ে ভারতে উপস্থিত হন। রণজিৎ দিল্লিতে মাওবাদী ছাত্রদের সংস্পর্শে এসে গান্ধী সম্পর্কে তার অনুমান করা অধ্যয়ন ছেড়ে কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
বিদ্রোহী হিসেবে কৃষকদের প্রতি এই আগ্রহের প্রথম গবেষণাকর্মটি ছিল বাংলায় ১৮৬০ সালের নীল বিদ্রোহের ওপর একটি বহুল আলোচিত নিবন্ধ, যা রণজিৎ ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার রেডিক্যাল জার্নাল ফ্রন্টিয়ারে প্রকাশ করেছিলেন। ২০ বছর আগে রণজিৎ একইভাবে বাংলা জার্নাল ‘পরিচয়’-এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে তার মৌলিক ভাবনা প্রকাশ করেছিলেন। সত্তর ও আশির দশকে ফ্রন্টিয়ারে প্রকাশিত গুহের কিছু সেরা কিন্তু ক্ষুদ্র পরিসরের কাজ যেমন নকশালদের ওপর পুলিশি দমন-পীড়নের তীব্র সমালোচনামূলক লেখাগুলো ছিল তীক্ষ ও প্রতিস্পর্ধী, যা প্রচলিত ইতিহাসকাঠামোর বাইরের ইতিহাস হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশেষত ১৯৭১ সালের ২৩ জানুয়ারি ফ্রন্টিয়ারে প্রকাশিত On Torture and Culture প্রবন্ধটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
রণজিৎ গুহ একজন পরিপূর্ণ এবং সাহসীভাবে আত্মসচেতন স্টাইলিস্ট হিসেবে গণ্য হন। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন জ্ঞানচর্চায় সক্রিয় একজন নিবেদিতপ্রাণ ইতিহাসবিদ।