রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সারা বিশ্বে খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য- সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি অসহনীয় হয়ে উঠছে। বৈশ্বিক এই বিরূপ পরিস্থিতির ছাপ পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। সাম্প্রতিক সময়ে আকর্ষণীয় রপ্তানি আয়েও ভাটার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে রপ্তানি আয় গত মাসের তুলনায় কমে গেছে। আর ডলারের বাজারে অস্থিরতায় কমেছে প্রবাসী আয়ও। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও উদ্যোগী হতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই মুহূর্তে প্রস্তুতি না নিলে রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন তারা। তবে আশার আলো হচ্ছে- বাংলাদেশি প্রোডাক্ট কম রেটের পণ্য হওয়ায় অন্যান্য দেশের তুলনায় কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে রপ্তানি। কারণ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে কম মূল্যের পণ্যের দিকে ঝুঁকেন ক্রেতারা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দার আঁচ পড়তে শুরু করেছে। দেশের তৈরি পোশাকের আরেক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা না হলেও মূল্যস্ফীতির কারণে তৈরি পোশাকের চাহিদা অনেকাংশে কমে আসবে। ইতোমধ্যে এসব দেশের মানুষ ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরেছেন। ব্যয়ের তালিকা কাটছাঁটও হচ্ছে তাদের। বিশ্বের এই বড় দুই বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে দেশের তৈরি পোশাক খাত। কমতে পারে রপ্তানি অর্ডার। কারণ তৈরি পোশাক রপ্তানির সিংহভাগ আয় আসে ইউরোপের বাজার থেকে। শুধু তৈরি পোশাক নয়, বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের আরেকটি খাত ফুটওয়্যার বা জুতা। বাংলাদেশি ফুটওয়্যারের বড় বাজার ইউরোপ। তাই ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা যত গভীর হবে, দেশের রপ্তানি আয়ের ধাক্কা তত গভীর হবে। তবে এই ধাক্কা সামাল দিতে এখনি আগাম পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। যদিও বৈশ্বিক এই মন্দায় উল্লেখযোগ্য কিছু করার না থাকলেও কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এসব আগাম প্রস্তুতির সঙ্গে একমত অর্থনীতিবিদরা।
ইউরোপের দেশগুলো সারা বছর যে সংখ্যক টি-শার্ট বা গেঞ্জি কেনে, তার প্রায় ৪১ শতাংশই বাংলাদেশি পোশাক কারখানা সরবরাহ করে। গত ছয় বছর ধরে ইইউতে টি-শার্ট রপ্তানিতে শীর্ষ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। শুধু টি-শার্ট নয়, পাঁচ বছর ধরে ট্রাউজার ও শর্টস প্যান্ট এবং চার বছর ধরে পুরুষ বা শিশুদের শার্ট রপ্তানিতে সেরাদের কাতারে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।
ইপিবির সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ দশমিক ৬৫ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। যার মধ্যে নিট পোশাক থেকে এসেছে ২ হাজার ৯৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। এর আগে অর্থাৎ এর আগের অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বৈশ্বিক এই মন্দায় বাংলাদেশের আসলে আহামরি কিছু করে লাভ নেই বা করারও কিছু নেই। তবে এখন থেকে আগাম কিছু প্রস্তুতি নিতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে। ইউরোপে মন্দা সৃষ্টি হলে দেশের তৈরি পোশাক খাতের অর্ডার কমে আসতে পারে। এছাড়া পণ্যের দামও কমে যেতে পারে। অনেকে বিলাসীপণ্য কেনা কমিয়ে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ক্রেতা ধরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে ইউরোপের ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পণ্যের অর্ডার বাতিল না করে। অর্থাৎ ভিয়েতনামে না যায়। বাংলাদেশের ফুটওয়্যার রপ্তানির অন্যতম বাজার ইউরোপ। এক্ষেত্রে ফুটওয়্যার রপ্তানিতেও ধাক্কা আসতে পারে। সব মিলে ইউরোপের মন্দার ওপর নির্ভর করে রপ্তানি আয়ের নেতিবাচক প্রভাব। রপ্তানির অন্যতম বাধা লিড টাইম। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানিতে সময় ব্যয়। বন্দর এবং কাস্টমসের কারণে। সরকারের পক্ষ থেকে লিড টাইম কমানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৪৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১২ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১০০ কোটি ডলারের পোশাক। সেই হিসাবে এবার রপ্তানি বেড়েছে দেড় গুণের মতো। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ তৃতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এই বাজারে গত বছর বাংলাদেশ ৭১৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। ২০২০ সালের চেয়ে এই আয় ছিল প্রায় ৩৭ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের প্রথম মাসে সেই প্রবৃদ্ধিকেও টপকে গেছে বাংলাদেশ। বরাবরই বাংলাদেশি পোশাকের বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় বিশ্বব্যাংকের সাবেক সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ও পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা হলে ইউরোপের জিডিপি ১ থেকে দেড় শতাংশ কমে যেতে পারে। আর অর্থনৈতিক মন্দা হলে উচ্চমূল্যের পণ্যে বেশি প্রভাব পড়ে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সৌভাগ্যবান বলা যায়। কারণ বাংলাদেশ লো ভ্যালু বা কমদামি পণ্য রপ্তানি করে থাকে। যার কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি আশঙ্কাজনক হারে কমবে না। কিন্তু রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর তুলনায় পণ্যের অর্ডারও কমে যাবে। আর তৈরি পোশাকের অর্ডার কমলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রপ্তানি আয়ে। কারণ দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা না হলেও মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তারা ভোগ্যপণ্য অর্থাৎ ফ্যাশনেবল পণ্যে আকৃষ্ট হবে না। সেক্ষেত্রে তাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি থাকবে নিত্যপণ্যের দিকে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও দেশীয় তৈরি পোশাকের চাহিদা কমবে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি আয় অন্যান্য বছরের তুলনায় কমে যেতে পারে বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।