ঠিক এই সময়টাতে যদি প্রশ্ন করা হয়—বাঙালিকে আর্জেন্টিনা চেনাল কে? এই প্রশ্ন শুনে আর্জেন্টিনার ভক্তকুল বলতে পারে—এ কেমন আনাড়ি প্রশ্ন? বিশ্বকাপের এই রকম একটা অবস্থায় শুধু বাঙালি কেন, গোটা বিশ্বের অগুনতি ফুটবলপ্রেমী কোনো না কোনো দলজ্বরে ভুগছে। বাঙালি বোধহয় বেশি ভুগছে আর্জেন্টিনা জ্বরে।
আর্জেন্টিনা আমাদের দেশ থেকে বহু দূরের একটি দেশ। সে দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগও তেমন একটা নেই। সেই বিশাল দেশে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাসও নেই। ব্রাজিলে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন আর্জেন্টিনাসহ ল্যাটিন আমেরিকার আরও কতক দেশে কূটনীতিক প্রতিনিধিত্বকারীর দায়িত্ব পালন করে মাত্র। আর সেই আর্জেন্টিনার নীল-সাদা পতাকা এ দেশের শহর-বন্দর থেকে শুরু করে গ্রামে-গঞ্জে শোভা পাচ্ছে!
শুরুটা সেই ১৯৭৮ সালে। সে বছরই ১১তম ফিফা বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় আর্জেন্টিনায়। ১৬টি দেশ অংশ নিয়েছিল। ফাইনালের মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও নেদারল্যান্ডস। দিয়েগো মারাদোনার জাদুকরী ক্রীড়াশৈলীর সুবাদে আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলের ব্যবধানে প্রথম বারের মতো ঘরে তোলে বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা। সেই থেকে দলটি দুনিয়া জুড়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা একেবারে উন্মাদনার জোয়ারে অবগাহন করে ফেনার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে বটে; কিন্তু সেই দেশ সম্পর্কে আমাদের তেমন কিছু জানা নেই। তবে আর্জেন্টিনার সঙ্গে যদি কোনো যোগসূত্র খুঁজতে যাই, তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। এই নাম আমাদের কাছে নানাভাবে পরিচিত। তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী বিপ্লবী, চিকিৎসক, গেরিলা নেতা। সারা বিশ্বে তিনি কিউবার বিপ্লবের অন্যতম রূপকার হিসেবে নন্দিত হয়েছেন। এরপর চে দেশ-কালের ঊর্ধ্বে উঠে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার নানা জায়গায় দেশাতীত বিপ্লবে ব্রতী হলেন, শহিদ হলেন বলিভিয়ার অরণ্যে। সে ইতিহাস চে-কে সর্বজনীন করে তুলেছে। সেখানে আর্জেন্টিনার সঙ্গে চে-কে মিলিয়ে দেখা হয় কম।
বাঙালির কাছে আর্জেন্টিনার পরিচিতির প্রশ্নে দিয়েগো মারাদোনা, গ্যব্রিয়েল বাতিস্তা, মারিও আলবার্তো হালের লিওনেল মেসি—এদের নামের আগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটি বসাতে চাই। রবীন্দ্রনাথ ফুটবল খেলতেন? কই কস্মিনকালেও তো শুনিনি। না, রবীন্দ্রনাথ ফুটবল খেলেননি কোনো দিন। তিনি আজীবন কলম নিয়ে খেলেছেন। কলমই তাকে বিশ্ব চিনিয়েছে, সেই কলমেই বিশ্ব চিনেছে বাঙালিকে। প্রকৃতপক্ষে বাঙালির সঙ্গে আর্জেন্টিনার মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিক্ষিত বাঙালির চিত্তে আর্জেন্টিনার প্রতীক হয়ে রয়েছেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, যিনি বিশ্বসংস্কৃতির মিলন ও একাত্মা রূপায়ণে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
১৯২৪ সাল। পেরুর সরকার তাদের স্বাধীনতা লাভের শতবর্ষ উপলক্ষে বিরাট উৎসবের আয়োজন করেছে। প্রধান অতিথি ব্রিটিশ ভারতের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভ্রমণপিয়াসী কবি বার্ধক্যের প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে দক্ষিণ আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সমুদ্রপথের যাত্রা বড় সহজ নয়। সবে আর্জেন্টিনায় পৌঁছেছেন। এমন সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কবি। আন্দেস পর্বতমালা অতিক্রম করে সুদূর লিমা নগরীতে যেতে হবে। কবির শরীর সেই ধকল সইতে পারবে না। কবির সহযাত্রী এবং কাজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী লেনার্ড এলমহার্স্ট, যিনি শ্রীনিকেতনের গোড়াপত্তন করেছিলেন। তিনি অসুস্থ কবিকে নিয়ে উঠলেন আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসের হোটেল প্লাজায়। সেখানেই হাজির হলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। পরিচয় হলো কবির সঙ্গে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো সাধারণ কেউ ছিলেন না। তিনি আর্জেন্টিনার প্রখ্যাত নারীবাদী লেখিকা। ত্রিশের দশক থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত প্রভাবশালী এক প্রগতিশীল পত্রিকা ‘সুর’-এর সম্পাদিকা। ব্যক্তিত্বময়ী এই নারী আর্জেন্টিনার শাসকের বিরোধিতার জন্য ১৯৫৩ সালে কারাবরণ করেন। তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি দান করেছিলেন আর্জেন্টিনার শিক্ষার উন্নয়নের জন্য।
ওকাম্পোর রবীন্দ্রদর্শনের ইচ্ছার পেছনে একটা ইতিহাস আছে। বহু ভাষায় পারদর্শী ওকাম্পো ছিলেন রবীন্দ্র-সাহিত্যের গুণমুগ্ধ পাঠক। রবীন্দ্রনাথ তত দিনে নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন (১৯১৩)। তার ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্য বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ওকাম্পো ইতিমধ্যে ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে ফেলেছেন ইংরেজি, স্প্যানিশ ও ফরাসি ভাষায়। এর মধ্যে আদ্রে জিদের ভাষায় করা ‘গীতাঞ্জলি’ অনুবাদটি ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে ওকাম্পো রীতিমতো রবীন্দ্রকাব্যের অনুরাগী হয়ে ওঠেন। হয়তো ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতাগুলো তার জীবনে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের লেখায় পরবর্তী কয়েক বছর বুঁদ হয়ে ছিলেন তিনি। তিনি ‘রবীন্দ্রনাথ পড়ার আনন্দ’ শিরোনামে এক চমৎকার প্রবন্ধ রচনা করেন।
এ ঘটনার বহু বছর পর কবির সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর দেখা হয়, প্রায় বছর দশেক পর—১৯২৪ সালের নভেম্বরের একটি দিনে। অসুস্থ কবিকে ওকাম্পো হোটেল থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন সান ইসিদরো শহরের ‘মিরালরিও’ নামের একটি বাড়িতে। মিরালরিও নামের অর্থ ‘নদীদর্শন’। এই বাড়ি রিও দে প্লাতা নদীর ধারে। কবি এখানে সপ্তাহখানেক থাকবেন, তারপর শরীর একটু ভালো হলে গন্তব্যে ফিরবেন; কিন্তু সেই থাকা ক্রমে দুই মাস হয়ে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওকাম্পোর পরিচয়ের পর এক হূার্দিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের তখন ৬৩ আর ওকাম্পোর ৩৪। রবীন্দ্রনাথ তার নাম রেখেছিলেন ‘বিজয়া’।
‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী…’ এই গানের ইংরেজি অনুবাদ ওকাম্পোর হাতে তুলে দিয়েছিলেন কবি আর্জেন্টিনায় আসার কয়েক দিনের মধ্যেই।
নদীতীরের সেই বাড়িতে কবি নতুন আনন্দে বেশ কিছু কবিতা লেখেন। ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের এই সূচনা। অনুপ্রেরণা বিজয়া, অর্থাৎ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। কাব্যটি উৎসর্গ করেছিলেন তাকেই। সুসাহিত্যিক, মানবতাবাদী এই নারী কেবল নিজের জীবনেই ব্যতিক্রমী ছিলেন না, রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভাকেও কখনো কখনো প্রভাবিত করেছিলেন। কবির সৃষ্টিকর্মে নতুন এক উদ্যম এনেছিলেন কবিতায়, চিত্রকলায় এমনকি বলা হয় তার নারীভাবনার উন্নয়নেও। কবি তার পাণ্ডুলিপিতে নানা রেখার দ্বারা সংশোধন ও সংযোজনকে চিহ্নিত করতেন। পাণ্ডুলিপির এসব চিত্র দেখেই ওকাম্পো কবিকে অনুরোধ করেছিলেন সেগুলো আরও বড় আকারে ক্যানভাসে আঁকার জন্য। এরপর রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রবাহ শুরু হয়। ছয় বছর পর কবির চিত্রপ্রদর্শনী হয় প্যারিসে। ইউরোপে কবির প্রথম প্রদর্শনীর সেই উদ্যোগের মূলে ছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৩০ সালে। তারপর চিঠির পাতায়, স্মৃতিচারণের ছন্দে একধরনের প্লেটনিক প্রেমেই ধরা ছিল তাদের বন্ধুত্ব। কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা সেই বন্ধুত্বে অন্তরায় হতে পারেনি। সেই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে আর্জেন্টিনার নামটিও যুক্ত হয়ে রইল চিরকালের জন্য।