রোজার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি, পরহেজগারি ও নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর; যেন তোমরা পরহেজগারি অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা :১৮৩)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘রোজা আমার জন্য, আমি নিজে রোজার প্রতিদান দেব (মুসলিম :২৭৬০)।’ সব ইবাদতই তো আল্লাহর জন্য। আসলে অন্য সব ইবাদত করার পাশাপাশি প্রদর্শনের সুযোগ ও মনোভাব থাকে, যেমন—নামাজ, হজ, জাকাত ইত্যাদি। কিন্তু রোজা আল্লাহ ও তার বান্দা ছাড়া প্রদর্শনের বা জাহির করার কোনো সুযোগই থাকে না। আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্যই আমাদের জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণের মূল নিয়ামক। এই আনুগত্য প্রকাশের অন্যতম উপায় হলো রোজা। দিনে রকমারি খাবারের প্রাচুর্য থাকার পরও বান্দা তা মুখে তোলে না। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে গেলেও পানি পান থেকে বিরত থাকে। প্রিয়জনের সঙ্গে ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে; কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগে খাওয়া হয় না। এদের উদ্দেশে হাদিসে বলা আছে, ‘যে আল্লাহ ও তার রসুলের (স.) আনুগত্য করে, সে-ই সফলকাম।’ মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদারের জন্য রয়েছে দৈহিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধন, আত্মিক ও নৈতিক অবস্থার উন্নতিসহ অশেষ কল্যাণ ও উপকার লাভ করার সুযোগ। রোজা মানুষকে সংযমী ও শুদ্ধ করে এবং অশ্লীল-মন্দ থেকে বিরত রাখে।
আর সে জন্যই প্রত্যেক মুমিন মুসলমান, সুস্থ অথবা রোগাক্রান্ত—সবাই রোজা রাখতে চান এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চান। তবে রমজানে রোগীরা প্রায়ই রোজা রাখবেন কি রাখবে না, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। অবশ্য কী কী অবস্থায় রোজা রাখা যাবে বা যাবে না, তার সুস্পষ্ট বিধান শরিয়তে আছে। আবার সুনির্দিষ্ট কারণে রোজা না রাখতে পারলে তার পরিবর্তে ক্ষতিপূরণস্বরূপ কাজা, কাফফারা, ফিদিয়া বা বদলি রোজা রাখার সুস্পষ্ট ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তার পরও রোজা পালনে যে আনন্দ, অনুভূতি, আত্মিক পরিতৃপ্তির সঙ্গে সংযম, কুপ্রবৃত্তি দমন, লোভ-লালসা, হিংসা, প্রতিহিংসা ইত্যাদি ত্যাগ করার যে আলোকোজ্জ্বল আমেজ-অনুভূতির চর্চা হয়, তা রমজানের রোজা ছাড়া অন্য কোনোভাবে লাভ করা যায় না। তাই রোগাক্রান্ত অবস্থায়ও অনেকেই রোজা রাখতে চায়। অনেকে এমনও বলে, ‘মরি মরবো, বাঁচি বাঁচব, তবু রোজা ছাড়ব না।’
রমজানে বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিস, পেপটিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিক আলসার, শ্বাসকষ্ট, হার্টের রোগ, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদিতে ভুগছে, তাদের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে রোজা রাখা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও রোজা রাখতে তারা প্রবল আগ্রহী। তারা যদি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোজার মাসের জন্য ওষুধ সেবনবিধি ঠিক করে নিতে পারে, তবে সহজেই রোজা রাখতে পারে। এতে রোজা ভাঙার বা রোজা থেকে বিরত থাকার কোনো প্রয়োজন হয় না।
রোজা রাখার উদ্দেশ্য শরীরকে দুর্বল করে অকর্মণ্য করা নয়, বরং শরীরকে সামান্য কিছু কষ্ট দিয়ে দৈহিক ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধন। শুধু তাই নয়, অনেক রোগের বেলায় রোজায় ক্ষতি না হয়ে বরং বহু রোগব্যাধির প্রতিরোধক এবং আরোগ্যমূলক চিকিৎসা লাভে সহায়ক হয়। রোজায় স্বাস্থ্যের সমস্যার চেয়ে বরং স্বাস্থ্যের উপকারই বেশি হয়।
ডায়াবেটিক রোগী :রোজা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রোগীদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ ও রহমতস্বরূপ। ডায়াবেটিক রোগীরা সঠিক নিয়মে রোজা রাখলে নানা রকম উপকার পেতে পারেন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল উপায় হলো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ আর রোজা হতে পারে এর প্রধানতম উপায়। যারা ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীল নয়, তাদের ক্ষেত্রে রোজা রাখা হতে পারে আদর্শ চিকিত্সাব্যবস্থা। যারা ইনসুলিন নেয়, তাদের ক্ষেত্রেও রোজা অবস্থায় ওষুধের মাত্রা কমাতে সহায়ক। শুধু রক্তের গ্লুকোজই নয়, রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণেও রোজা মোক্ষম। এর সঙ্গে সঙ্গে রোজা ডায়াবেটিক রোগীকে সংযম, পরিমিতিবোধ ও শৃঙ্খলার শিক্ষা দেয়, যা ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় অপরিহার্য।
রক্তে কোলেস্টেরল ও অতিরিক্ত ওজন : যাদের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি, রোজা তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। রোজা ভালো কোলেস্টেরলকে (এইচডিএল) বাড়াতে এবং মন্দ কোলেস্টেরলকে (এলডিএল) ও ট্রাইগ্নিসারাইড কমাতে সাহায্য করে। যাদের ওজন বেশি, রোজা ওজন কমানোর আরেকটা সহজ সুযোগ। ওজন কমে যাওয়ায় বিভিন্ন রোগ থেকে বেঁচে থাকা যায়, যেমন—উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, বাতের ব্যথা, অস্টিও আর্থ্রাইটিস, গাউট ইত্যাদি।
হৃদরাগী ও উচ্চরক্তচাপ :রোজার মাধ্যমে ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ হওয়ার ফলে যারা হৃদরোগে অথবা উচ্চরক্তচাপে ভোগেন, তাদের জন্য রোজা অত্যন্ত উপকারী। এতে শরীরের, বিশেষ করে রক্তনালীর চর্বি হ্রাস পায়, রক্তনালীর এথেরোসেক্লরোসিস কমাতে সাহায্য করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
পেপটিক আলসার :একসময় ধারণা ছিল, পেপটিক আলসারে আক্রান্ত রোগীরা রোজা রাখতে পারবে না, তাদের ঘন ঘন খাবার খেতে হবে, অনেকক্ষণ পেট খালি রাখা যাবে না। অনেকে মনে করে, রোজা পেপটিক আলসারের ক্ষতি করে এবং এসিডের মাত্রা বাড়ায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব ধারণা ঠিক নয়। রোজায় নিয়ন্ত্রিত খাওয়া-দাওয়ার ফলে অ্যাসিডের মাত্রা কমে যায়। তাই সঠিকভাবে রোজা রাখলে এবং সঠিক খাবার দিয়ে সেহরি ও ইফতার করলে রোজা বরং আলসারের উপশম করে, অনেক সময় আলসার ভালো হয়ে যায়। এছাড়া রোজা গ্যাস্ট্রাইটিস, ওইউ ইত্যাদি রোগেও উপকারী।
শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা রোগী : যারা এসব রোগে ভোগে, তাদেরও রোজা রাখতে কোনো অসুবিধা নেই। রোজায় এ ধরনের রোগ সাধারণত বৃদ্ধি পায় না। বরং চিন্তামুক্ত থাকায় এবং আল্লাহর প্রতি সরাসরি আত্মসমর্পণের ফলে এই রোগের প্রকোপ কমই থাকে। প্রয়োজনে রাতে একবার বা দুবার ওষুধ খেয়ে নিলে দীর্ঘক্ষণ শ্বাস নিয়ন্ত্রণে থাকে। এ ধরনের ওষুধ বাজারে সহজেই পাওয়া যায়। দিনের বেলায় প্রয়োজন হলে ইনহেলারজাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যায়, যা রোজার কোনো ক্ষতি করবে না।
উপসংহারে বলা যায়, রোজা যেহেতু আল্লাহ তাআলার জন্য এবং আল্লাহ এর পুরস্কার দেবেন, তাই কেউ যদি মনে করে আমি আল্লাহর জন্যই রোজা রাখব, যা হওয়ার হবে, তার কোনো সমস্যাই হবে না। আর যারা মনে করবে রোজা রাখলে নানা রকমের সমস্যা হবে, রোগের প্রকোপ বাড়বে, নানা রকম জটিলতা হবে, তাদের বেলায় এসব সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। দৈহিক রোজার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের রোজাটাই আসল, তাই কোনো অজুহাত বা আলস্য করে রোজা পালন থেকে বিরত থাকা উচিত নয়। আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, রোজা একটি স্বাস্থ্যসম্মত বিধান, যা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা ও নানাবিধ কঠিন রোগের আগমন প্রতিহত করে।