তেইশ বছর বয়সী সাবিহা (ছদ্ম নাম)। রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জে সোনা মসজিদ স্থলবন্দরে মালামাল ওঠানো-নামানোর কাজ করত সে। সেখানেই এক লরি চালকের সঙ্গে সাবিহার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রণয়। প্রতি সপ্তাহেই ওই চালক মাল নিয়ে আসত। ততদিনে তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক পর্যায় ওই লরি চালক আর আসে না। নৃবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে টোমাকোভা (কাজ করে চলে যায়, আর কোনদিন ফিরে আসে না)।
এদিকে সাবিহাও অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়ে। তবে গর্ভের সন্তান জন্মদানে বদ্ধ পরিকর সে। এক ছেলে সন্তান জন্ম দেন তিনি। কিন্তু পরিবার আর সমাজের মানুষের চাপে সন্তানকে আগলে রাখতে পারেনি। ফুটফুটে সন্তানটিকে রাজশাহী তেরখাদিয়ায় এসওএস শিশুপল্লীর মায়ের হাতে তুলে দেয় সাবিহা। শুধু সাবিহা নয়, যৌনকর্মী আম্বিয়ার (ছদ্ম নাম) কোলের শিশুটিও এখন বেড়ে উঠছে এই পল্লীর আরেক মায়ের ঘরে।১৯৭৯ সালে আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষে তেরখাদিয়ায় রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত জমির উপর দ্বিতীয় এসওএস শিশু পল্লীটি স্থাপিত হয়। ১৫টি বাড়ি, কমিউনিটি সেন্টার ও কিন্ডারগার্টেন নিয়ে গড়ে ওঠা এই পল্লীতে বর্তমানে ১০৫ ছেলেমেয়ে একসাথে বসবাস করছে। যদিও ধারণ ক্ষমতা দেড়শ জনের। এই পল্লী প্রতিষ্ঠায় অর্থ যোগান দেয় নরওয়ে এস ও এস শিশু পল্লীর স্পন্সর বন্ধুরা।
পল্লীর অ্যাসিটেন্ট ডিরেক্টর ড. ইকরাম নেওয়াজ ফরাজী সমকালকে বলেন, যেসব শিশুরা স্নেহ-ভালোসা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত ও নানান দুর্ভোগের শিকার হয়ে এসওএস শিশুপল্লীতে আসে, তারা এখানে যত্নশীল ও সুরক্ষিত পরিবেশে বেড়ে উঠার সুযোগ পায়। এসওএস শিশুপল্লীতে ‘এসওএস মা’ হিসেবে পরিচিত একজন প্রশিক্ষিত যত্নদানকারী একটি স্নেহশীল পরিবার গড়ে তুলেন। যার ভেতর শিশুরা শেখে পারিবারিক মূল্যবোধ এবং দায়িত্বশীলতা। এই মা শিশু যত্নের আদর্শ মান বজায় রেখে দক্ষতার সাথে পরিবারটি পরিচালনা করেন। শিশুদের চাহিদা পূরণ এবং
অধিকার রক্ষায় তিনি পল্লী পরিচালক ও অন্যান্য সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। ফলে শিশুরা তাদের অতীত বঞ্চনা থেকে বের হয়ে আসে এবং সুন্দর পারিবারিক পরিবেশে একটি উন্নয়ন পক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে। এভাবেই এসওএস শিশুপল্লী প্রত্যেক শিশুর জন্য একটি স্নেহশীল আবাস হয়ে ওঠে।
পদ্মা নদী বিধৌত অঞ্চল হচ্ছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী। প্রমত্তা পদ্মা নদী গোদাগাড়ীকে পূর্ব-পশ্চিম দুই অংশে বিভক্ত করেছে। নদীর অপর পাড়েই ভারতের বিখ্যাত ভগবানগোলা অবস্থিত। আর এপাড়ে গোদাগাড়ী, মোহনপুর, গো গ্রাম, মাটিকাটা, বাসুদেবপুর, চড় আষাড়িয়াদহ ইত্যাদি ইউনিয়নে এসওএস শিশুপল্লীর রাজশাহীর সামাজিক কেন্দ্রের পরিবার শক্তিশালীকরণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
জানা যায়, বিশ্বের ১৩৭টা দেশে ৫৮০টি শিশুপল্লী রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৬টি। রাজশাহী সহ ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, খুলনা ও সিলেটে গড়ে ওঠেছে এসব শিশুপল্লী। প্রধানত মা, ভাই-বোন, বাসস্থান ও শিশুপল্লী এই চারটি নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে এগুলো পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে সংস্থাটি পরিচালিত হয়ে আসছে।
রাজশাহীর শিশুপল্লীতে ১৫টি ঘর রয়েছে। এসব ঘরগুলোতে মা হিসেবে মাসকুরা বেগম, গুলনাহার বেগম, পপি বেগম সহ আরও ১২ মা রয়েছেন। এছাড়াও পল্লীর মায়েদের সহযোগিতার জন্য ৫ জন ‘এসওএস আন্ট (খালা)’ রয়েছেন, যারা ঝাড়ূ দেয়া, রান্নার কাজ সহ অতিথিদের আপ্যায়ন করে থাকেন। এসব পল্লীতে শুণ্য থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের নেওয়া হয়। এখানকার মা পপি জানান, সমাজে একটি পরিবার যেভাবে বেড়ে ওঠে, এসওএস শিশুপল্লীর পরিবারগুলোও তেমনি। মায়া-মমতায় পরিবারের সন্তানদের নিয়ে থাকেন তারা।
এদিকে ঢাকার শ্যামলীস্থ শিশুপল্লীতে মা-বাবা হারিয়ে ছোট্ট শিশু আতিকও পেয়েছে গোটা পরিবার। মাত্র ২ বছর বছর বয়সে এই শিশুপল্লী পরিবারের সদস্য হয় সে। বর্তমানে তার বয়স ১৮ বছর। এই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মিরপুরের হারম্যান মেইনার কলেজে স্নাতকের শিক্ষার্থী। লেখাপড়ার পাশাপাশি আতিক শিশুপল্লীতে ঘরের বড় ছেলে হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শিশুপল্লীতে বেড়ে ওঠা অন্য ছোট ছেলেমেয়েদেরও নিজের ভাইবোনের মতোই ভালোবাসেন আতিক। জন্মের পর থেকে শিশুপল্লীতে বেড়ে ওঠা আতিক তার বাবা-মাকে কখনও দেখেননি। তাদের অভাবও খুব একটা বোধ করেননি। কারণ এই পল্লীতেই প্রতিটি শিশুর জন্য মায়ের ভালোবাসা বিলিয়ে দেন ‘মা’ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত নারীরা।
আজ ২৩ জুন। শিশুপল্লীতে বেড়ে ওঠা শিশু আর যাদের মমতায় তারা বেড়ে ওঠে, সেইসব মমতাময়ী মায়েদের সম্মানে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক এসওএস শিশুপল্লী দিবস।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে অনেক শিশু মাতৃ-পিতৃহীন হয়ে পড়ে। এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন অস্ট্রিয়ার নাগরিক অধ্যাপক হারম্যান মেইনার। তার মনে বারবার দোলা দিতে থাকে, কী করা যায়। সেই ভাবনা থেকেই ১৯৪৯ সালে তিনিই অস্ট্রিয়ায় প্রথম এসওএস শিশুপল্লী প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমানে ১৩৭টি দেশে তার চিন্তার ফসল এসওএস শিশুপল্লীর কার্যক্রম বিস্তৃত। প্রতি বছর তার জন্মদিন ২৩ জুন বিশ্বব্যাপী এসওএস শিশুপল্লী স্থাপনাগুলোতে আন্তর্জাতিক এসওএস শিশুপল্লী দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়েছে। এসওএস মানে সোশ্যালি রেসপনসিবল সোসাইটি অথবা সোশ্যাল সার্ভিস সোসাইটি। সহজ কথায় দায়িত্বশীল সমাজ।