রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা উচিত। অপ্রচলিত মুদ্রানীতির পূর্ববর্তী সময়ে যখন ইসিবি মূলত পাবলিক সেক্টর পারচেজ প্রোগ্রামের (পিএসপিপি) মাধ্যমে সম্পদ ক্রয় করত, তখনো তারল্যের ইনজেকশনটি মূলত ইউরোপীয় ব্যাংক খাতের কাছে ছিল, যেখানে তারা মুদ্রানীতি কর্মসূচি থেকে লাভের বিপরীতে অলাভজনক ঋণগুলো রাইটঅফ করার অনুমতি দিয়ে ব্যাংকের ব্যালান্সশিট সমন্বয়ে সহায়তা করেছিল। এর বিপরীতে মহামারির সময়ে প্যানডেমিক ইমার্জেন্সি পাবলিক প্রোগ্রামের (পিইপিপি) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্প্রসারণমূলক রাজস্বনীতি সরাসরি পুনঃ অর্থায়ন তৈরি করেছে। এ প্রক্রিয়া কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিনের মুদ্রা ওভার হ্যাংয়ের ধারণা বা অনুরূপ যুক্তির আর কোনো প্রয়োজন ছিল না। যে কোনো ক্ষেত্রে অত্যধিক পাবলিক ঋণের প্রভাবের ওপর জোর দিয়ে সিন তার বইটিতে মূল্যস্ফীতির পুনরুজ্জীবনের বিষয়ে সতর্কবাণী দেওয়াসহ অন্যান্য সাম্প্রতিক কাজেরও প্রশংসা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে লেখা লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের চার্লস গুডহার্ট ও মনোজ প্রধানের বই ‘দ্য গ্রেট ডেমোগ্রাফিক রিভার্সাল’ এ হেড মাইক্রো সম্পর্কে বলা হয়, সামাজিক বার্ধক্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধীর করবে, পরিবারের সঞ্চয় কমাবে এবং রাজস্বের বোঝা বাড়াবে। কারণ তরুণদের ছোট দলগুলো অবসরপ্রাপ্তদের একটি বড় অংশকে দেখাশোনা করবে। আর এই শক্তিগুলো নিজেরাই মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি করবে এবং বিশ্বায়নের গতিশীলতা কমে যাওয়ার ফলে তাদের মধ্যে সংযোজিত হবে, যেখানে কাঠামোগত উপাদান অপসারণ করা হবে, যা মূল্যহ্রাস করেছিল।
২০১৩ সালে আরেকজন দূরদর্শী, যিনি মূল্য সংযম সমাপ্তির ঝলক দেখেছিলেন, তিনি হলেন কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক ব্রিগিট গ্রাানভিল, তিনি ‘রিমেম্বার ইনফ্লেশন’ বইয়ে লিখেছিলেন, যেখানে ঐতিহাসিকভাবে মূল্যস্ফীতিতে রাজস্বনীতির ভূমিকার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। মূল্যস্ফীতির ফিরে আসা থেকে বেশ কয়েকটি শিক্ষা রয়েছে। প্রথমত মূল্যস্ফীতি একটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক ঘটনা। শুধু নির্দিষ্ট মূল্যের উপাদান যেমন জ্বালানির দিকে তাকানোটাই আসলে যথেষ্ট নয়, সেখানে জ্বালানির মূল্য শিগিগরই শীর্ষে পৌঁছে যাবে—এমন আশার সম্ভাবনা তো বহু দূরের চিন্তা। দ্বিতীয়ত, আজকের উচ্চ মূল্যস্ফীতি খুব কম পরিমাণ পণ্য ও পরিষেবার জন্য অত্যধিক ব্যয়ের ফল হিসেবে এসেছে। যেমন—মূল্যস্ফীতি এবার অনেক বাজার অংশগ্রহণকারীর দাবির চেয়েও বেশি স্থায়ী হতে পারে। তৃতীয়ত, মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও আর্থিক স্থিতিশীলতার মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক মূল্যস্ফীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং ঋণের স্থায়িত্ব ও প্রত্যাশাকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ করে তোলে। এই শিক্ষা তিনটি ব্যাপক নীতির ওপর প্রভাব রাখে। প্রথমত, বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য মুদ্রানীতি সীমাবদ্ধ করা দরকার। দ্বিতীয়ত, মুদ্রানীতির রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে রাজস্বনীতি সাংঘর্ষিক হওয়া উচিত নয়। এবং তৃতীয়ত, রাজস্বনীতিকে অবশ্যই আরো বিশ্বাসযোগ্য এবং টেকসই অবস্থানে ফিরে আসতে হবে।
এ ধরনের নীতিগত পরিবর্তন অবশ্যই কিছুটা ঝুঁকি বহন করবে। আমরা সাম্প্রতিক অবস্থা থেকে বুঝতে পারি যে, মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া আর্থিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। যদিও ব্যাংকগুলো ঝুঁকিমুক্ত সম্পদ হিসেবে প্রচুর পরিমাণ সরকারি বন্ড রাখে, তার পরও স্বল্পমেয়াদি আমানত দীর্ঘমেয়াদি ঋণে পরিণত করার ক্ষেত্রে তারা পরিপক্বতার সঙ্গে জড়িত। যখন সুদের হার বাড়ে, তখন সরকারি বন্ডগুলো বাজারমূল্য হারায়। এর ফলে ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিট রাইটঅফ করা হয়। সুতরাং, ব্যাংকগুলোর এই ক্ষতি সামলানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ রিজার্ভ প্রয়োজন। যদি তা না হয়, তবে ব্যাংকে রান তৈরি হতে পারে। (ব্যাংকে রান হচ্ছে এমন একটা অবস্থা, যখন ব্যাংক গ্রাহকেরা মনে করেন যে, নিকট ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং অনেক গ্রাহক একসঙ্গে ঐ ব্যাংক থেকে তাদের আমানত তুলে নেয়)।
এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেলআউট প্রদান করতে অথবা সুদের হার বৃদ্ধি স্থগিত করতে বাধ্য হতে পারে। মুদ্রানীতির আর্থিক আধিপত্য তাই মূল্যস্ফীতি অব্যাহত রাখতে ভূমিকা রাখবে। যারা সতর্ক করছে যে, অধিক মুদ্রানীতি রক্ষণাবেক্ষণের সংশোধনী ‘কিছু না কিছু ভেঙে ফেলবে’, তাদের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু সেই যুক্তি মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত বিপরীতমুখী। মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে মূল্যের উপাদানের দিকে নজর দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে জ্বালানিমূল্যের বিষয়টি উঠে আসে। কয়েক জন পর্যবেক্ষক বর্তমান মূল্যবৃদ্ধিকে ‘পুতিনের মূল্যস্ফীতি’ হিসেবে গণ্য করেছেন। কেননা, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ বাণিজ্যিক সংস্থা ও গৃহস্থালির জ্বালানি খরচ গত বছর বাড়িয়ে তোলে। এই বর্ণনা আশা জাগায়, ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতি অনেক কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে চলতি বছর জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি না পাওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে, এমনকি হ্রাস না পাওয়ার বিষয়টিও বলা হয়েছে। এ অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে কয়েক জন বিশ্লেষক ঝুঁকির লক্ষ্য অতিক্রম করার ক্ষেত্রে ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মুদ্রানীতি আঁটোসাঁটো করার বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
এসব সতর্কতা আসলে অপরিপক্ব, যদি হিতে বিপরীত না হয়। বস্তুত, দ্বিতীয় দফা প্রভাবের কারণে মূল্যস্ফীতি বজায় থাকার প্রবণতা কাজ করে। এ সময় শুধু উত্পাদক পর্যায়ে অধিক মূল্য বেড়েছে এমন নয়, কিন্তু মূল্যের শৃঙ্খলের মধ্য দিয়ে পুরোপুরি অতিবাহিতও হয়নি। সর্বোপরি নামমাত্র মজুরি এরই মধ্যে বেড়েছে এবং এ বছর আরো বাড়বে। উদাহরণ হিসেবে ইউরোপিয়ান সেল ব্যাংকের (ইসিবি) তথ্যানুসারে ইউরো জোনে ডে ইউনিয়ন ও নিয়োগকর্তা সংস্থাগুলোর সম্মতিতে এরই মধ্যে ৫ শতাংশ মজুরি বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে সংস্থাগুলো এ খরচ তাদের ক্রেতাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করবে। ফলে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি পেশাজীবীদের বর্তমান পরামর্শের তুলনায় সম্ভবত বেশি থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মূল্যের উপাদানের প্রাসঙ্গিক শক্তির প্রতি মনোযোগ (জ্বালানির মূল্যের মতো) সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর ব্যষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তিকে বাড়িয়ে তুলেছে। মূল্যস্ফীতি সব সময় যা ছিল, এখনো তা-ই আছে, সামষ্টিক অর্থনীতি বরং চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতার ফলাফল থেকে উঠে আসছে এবং সেই সঙ্গে এটি মুদ্রা ও রাজস্বনীতি দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে।