‘রাজাপাকসে কি তোমাদের দেশের মানুষের একমাত্র শেষ নাম?’-শ্রীলঙ্কার একটি জনপ্রিয় ঠাট্টার প্রধান লাইন এটি। ঠাট্টাটি অনেকটা এরকম যে, একজন কল্পিত চীনা সরকারি কর্মকর্তা শ্রীলঙ্কা সফরে এসে হতবিহ্বল হয়ে যান, যখন তিনি দেখেন যে উচ্চপদস্থ যেই ব্যক্তির সাথেই তিনি দেখা করেছেন, তার নামের শেষেই রাজাপাকসে রয়েছে। এটি একটি কল্পিত গল্প, এবং গল্পটি ঠাট্টাচ্ছলে ছড়িয়ে পড়লেও এই ঠাট্টাটি কিভাবে ছড়িয়ে পড়লো, তা সহজেই বোঝা যায়।প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ১৩ই জুলাই বিক্ষোভের মুখে শ্রীলঙ্কা ছেড়ে পালানোর আগে দ্বীপদেশটির ওপর তার পরিবারের শক্ত দখল ছিল গত দুই দশক ধরে। তবে শ্রীলঙ্কার ওপর রাজাপাকসেদের এই আধিপত্য এখন শেষ হওয়ার পথে। যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর গত সাত দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা, যার কারণ হিসেবে ক্ষমতাসীনদের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে দায়ী মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বছরের শুরুতেও শ্রীলঙ্কার সরকারে ছয়জন রাজাপাকসে ছিলেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সরকারি ক্ষমতায় এই পরিবারের প্রভাব হয়তো দ্রুতই ম্লান হয়ে যাবে।
এ বছরের মে মাসে পদত্যাগ করেন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসের বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের প্রভাব সবসময় এত প্রবল ছিল না। মাহিন্দা রাজাপাকসে হয়ে ওঠেন এই পরিবারের সবচেয়ে আলোচিত এবং প্রভাবশালী সদস্য।
রাজাপাকসেরা শ্রীলঙ্কার দক্ষিণের হাম্বানটোটা অঞ্চলের ভূস্বামী পরিবারের সদস্য। মাহিন্দা আর তার বড় ভাই চামাল আশির দশকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শ্রীলঙ্কায় ১৯৮৭ -৮৯ সালে এক বামপন্থী বিদ্রোহে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন মাহিন্দা। প্রধানমন্ত্রী চান্দিকা কুমারাতুঙ্গার সময় ১৯৯৪ সালে শ্রম মন্ত্রী নির্বাচিত হন মাহিন্দা। দশ বছর পর তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং পরের বছরই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় লাভ করেন।
মাহিন্দা দুই দফায় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যখন প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন, তখন তার ভাই গোতাবায়াকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নিয়োগ করেন। গোতাবায়া শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে নিভৃত জীবনযাপন করছিলেন। তার জন্য এটা ছিল এক বিরাট রাজনৈতিক উত্থান।
তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের ২০০৯ সালে নির্মমভাবে দমনের মাধ্যমে তিন দশক ধরে চলা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি টেনেছিলেন তিনি। সেসময় মাহিন্দা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে।
অভিযোগ আর বিতর্ক রাজাপাকসেদের শ্রীলঙ্কার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ থেকে সরাতে পারেনি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সময় গোতাবায়া রাজাপাকসে খ্যাতি অর্জন করেন গৃহযুদ্ধ দমনে তার নেয়া পদক্ষেপের জন্য। কৃষি, মৎস্য ও সেঁচ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন মাহিন্দার বড় ভাই চামাল। আরেক ভাই বাসিল ছিলেন অর্থ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে।
এই চার ভাইয়ের আরো আত্মীয় বিভিন্ন সরকারি দফতরের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন- যাদের মধ্যে ছিলেন মাহিন্দার ছেলে নামাল, যিনি ছিলেন শ্রীলঙ্কার ক্রীড়ামন্ত্রী, এবং যোশিথা, যিনি তার বাবার পদত্যাগের আগ পর্যন্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রধান।
মাহিন্দা ও গোতাবায়া রাজাপাকসেকে সবসময় ঐক্যবদ্ধ দেখা সম্প্রতি তাদের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল দেখা যায়। তবে মাহিন্দার বড় ছেলে নামাল দুই ভাইয়ের মধ্যে এরকম কোনো দ্বন্দ্বের কথা অস্বীকার করেছেন। মে মাসে মাহিন্দা রাজাপাকশার পদত্যাগের আগে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, তার বাবা মাহিন্দা রাজাপাকসে সবসময় কৃষক এবং জনগণের পক্ষে ছিলেন, অন্যদিকে গোতাবায়া রাজাপাকসে ক্ষমতাসীন দল এসএলপিপির মূল সমর্থক এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেয়ে দোদুল্যমান ভোট টানতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন।
বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল টাইগারদের (এলটিটিই) পরাজয়ের পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল দুই রাজাপাকসে ভাইয়ের। বলা হয় কয়েক দশক ধরে চলা শ্রীলঙ্কার ওই গৃহযুদ্ধে অন্তত এক লাখ মানুষ মারা যায়। গৃহযুদ্ধের শেষদিকে হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়। অনেকেই নির্যাতিত হয়েছেন বা নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এরকম অনেক অভিযোগ রয়েছে যেখানে আত্মসমর্পণ করা এলটিটিই সেনাদের হত্যা করা হয়েছে। সাদা পতাকা দেখানোর পর বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নেয়ার পরও তাদের হত্যা করা হয়েছে- এমন অভিযোগও রয়েছে। তারা বলছেন, এসব ঘটনার ভিডিওসহ প্রমাণও রয়েছে। তবে সরকার সবসময়ই ঢালাওভাবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরবর্তী বছরগুলোতেও গুমের ঘটনা অব্যাহত থেকেছে। তারা বলছেন, রাজাপাকসেদের বিরোধী হিসেবে মনে করা হয়, এমন ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের আটক করার পর তাদেরেকে আর কখনো দেখা যায়নি। ওইসব ব্যক্তিদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে রাজাপাকসে সরকারের কোনোরকম সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করে তারা।
যুদ্ধের সময় নিখোঁজ হয়ে যাওয়া তামিল সেনাদের পরিবারের সদস্যরা আজ অবধি তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের পরিণতি পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার উদ্দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। বহু বছর ধরে শ্রীলঙ্কার সিংহলিদের মধ্যে রাজাপাকসেদের বিরাট জনপ্রিয়তা ছিল, যদিও তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন এবং গণমাধ্যমের ওপর মারাত্মক সব হামলার অভিযোগ ছিল। সিংহলিদের অনেকেই তখন এসব নিয়ে কথা বলেনি।
কিন্তু পুরো দেশ যখন সঙ্কটে পড়েছে, তখন জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ সব জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। সিংহলি বিক্ষোভকারীরাও এখন সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন।