ব্রিটেনের রয়্যাল ফ্যামিলির (ঐতিহ্যবাহী ব্রিটিশ রাজপরিবার) উপস্থিতিতে ৪ হাজার ব্রিটিশ ও কমনওয়েলথ সেনা, এক শর মতো বিশ্বনেতা এবং লাখ লাখ টেলিভিশন দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে সাত দশক ধরে চলে আসা যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় আনুষ্ঠানিক ইভেন্টে রাজা তৃতীয় চার্লসকে (চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ) রাজমুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করেছে যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্র। ৭০ বছর পর যুক্তরাজ্যের জনগণ পেয়েছে নতুন রাজা! চলতি সপ্তাহের শনিবার এক জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে অভিষেক হয় রাজা তৃতীয় চার্লসের। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করলেন এই ব্রিটিশরাজ।
একই দিনে রানি (কুইন কনসোর্ট) হিসেবে অভিষেক হয়েছে রাজা তৃতীয় চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলারও (ক্যামিলা রোজম্যারি সান্ড)। যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সময় দুপুর ঠিক ১২টা ২ মিনিটে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে রাজা তৃতীয় চার্লসের মাথায় নিখাদ সোনার ‘সেইন্ট অ্যাডওয়ার্ড মুকুট’ পরিয়ে দেন ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি। মহামূল্যবান ও সম্মানের প্রতীক এই মুকুট ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী ও পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু হলে ব্রিটিশ রেওয়াজ ও নীতি অনুযায়ী তার বড় ছেলে তৃতীয় চার্লস যুক্তরাজ্যসহ ১৬টি দেশের রাজা হন। অপেক্ষা ছিল কেবল আনুষ্ঠানিক রাজ-অভিষেকের। শেষ পর্যন্ত শনিবারের রাজকীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রায় ছয় যুগ পর রাজমুকুট ওঠে রাজা তৃতীয় চার্লসের মাথায়। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ৪০তম সিংহাসন আরোহী হিসেবে রাজা চার্লসের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ন্যায্যতার ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা ও চার্চ অব ইংল্যান্ডকে সমুন্নত রাখার শপথবাক্য। প্রথা মাফিক শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপ। এ সময় আর্চবিশপকে বলতে শোনা যায়, ‘ঈশ্বর, রাজাকে হেফাজত করুন।’ রাজাকে উদ্দেশ্য করে আর্চবিশপ আরো বলেন, ‘নতুন রাজা যেন তার শাসনকালে আইনের শাসন ও চার্চ অব ইংল্যান্ডের মর্যাদা সমুন্নত রাখেন।’ এ সময় রাজা তৃতীয় চার্লস পবিত্র ‘গসপেলে’ হাত রেখে আইনের শাসন ও চার্চ অব ইংল্যান্ডের মর্যাদা সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া একজন ‘একনিষ্ঠ প্রোটেস্ট্যান্ট’ হিসেবে দ্বিতীয় শপথও গ্রহণ করেন রাজা চার্লস। শপথ অনুষ্ঠানে বাইবেল থেকে পাঠ করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। রাজ-অভিষেকের বিষয়ে সুনাক বলেন, ‘এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃৃতি ও ঐতিহ্যের গৌরবময় অভিব্যক্তি।’
জাঁকজমকপূর্ণ ও কঠোর আনুষ্ঠানিকতার এই দিনে হাজার বছরের বেশি সময় আগে থেকে শুরু হওয়া রীতিনীতির ছাপ ছিল। ছিল বেশ কিছু ব্যতিক্রমও। স্থানীয় সময় সকাল ৬টায় বাকিংহাম প্যালেস থেকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের উদ্দেশে শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক উদ্যাপন। শোভাযাত্রায় অংশ নেন সামরিক বাহিনীর প্রায় ২০০ সদস্য, যাঁদের অধিকাংশই ‘সভারিন এসকর্ট অব দ্য হাউজহোল্ড ক্যাভালরি’র সদস্য। এ ছাড়া শোভাযাত্রায় অংশ নেন হাজার খানেক সেনাসদস্য।
উল্লেখ করা দরকার, রাজ-অভিষেক অনুষ্ঠান ঘিরে কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়ে আসছিল নিরাপত্তা বাহিনী। প্রায় ১০০ দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের উপস্থিতির কথা মাথায় রেখে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয় পুরো এলাকা। নিশ্চিত করা হয় নির্বিঘ্ন, নিরাপদ পরিবেশ। পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থীর জন্য রাখা হয় বিশেষ ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে রাজ-অভিষেক অনুষ্ঠান ঘিরে বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে বিরাজ করে সাজ সাজ রব। শুরু হয় আনন্দ উৎসব। অনুষ্ঠানের দিন তো বটেই, কয়েক সপ্তাহ ধরেই নতুন রাজাকে শুভেচ্ছা জানাতে থাকেন অনেকে। পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উষ্ণ অভ্যর্থনা ও প্রার্থনা জানানো হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে। রাজা তৃতীয় চার্লস ও রাজপরিবারের সদস্যরা বাকিংহাম প্যালেসের ভেতরে-বাইরে শুভাকাঙ্ক্ষীদের শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও প্রার্থনায় সিক্ত হন।
মূল অনুষ্ঠানের দিন লন্ডনের টাওয়ারে টাওয়ারে শোভা পেতে থাকে নতুন রাজার ছবিসংবলিত শুভেচ্ছাবার্তা। রাজধানী পেরিয়ে এই মহা উৎসব ছড়িয়ে পড়ে গোটা যুক্তরাজ্যে। জিব্রাল্টার, বারমুডা প্রণালীসহ সমুদ্রবক্ষের জাহাজে জাহাজে বন্দুকের ফাঁকা গুলি ছুড়ে শুভেচ্ছা জানানো হয় রাজাকে। সম্মান প্রদর্শন করা হয় স্যালুট জানিয়ে। রাজ-অভিষেকের মূল অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত আনন্দোত্সবের চিত্র সম্প্রচার করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। বলতেই হয়, ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সিংহাসন আরোহণের এ ধরনের দূরদর্শী উপস্থাপন এমন এক প্রয়াস, যা হাজার বছরের ব্রিটিশ ঐতিহ্যকে সবার সামনে মেলে ধরে। প্রতিফলিত করে সব ধর্মের প্রতি ‘বৈচিত্র্যময় যুক্তরাজ্যের’ শ্রদ্ধার চিত্র। টুইট বার্তায় যেমনটা লিখেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক—‘এটা এমন এক লালিত ও পরম আকাঙ্ক্ষিত অনুষ্ঠান, যার মাধ্যমে শুরু হয় নতুন পথচলা, নবযুগের যাত্রা।’ তিনি আরো বলেন, ‘অন্য কোনো দেশ এমন জমকালো প্রদর্শনের আয়োজন করতে পারেনি কখনই।’ সুনাক আরো লিখেছেন, ‘এটা শুধু একটি দর্শন নয়, বরং এটা আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক গর্বিত অভিব্যক্তি।’
তবে এ কথাও বলে রাখা দরকার, রাজার অভিষেক ঘিরে উত্সাহ ছিল না একটি অংশের! তাই লন্ডনের ঐতিহাসিক ট্রাফালগার স্কয়ার ও শোভাযাত্রার পথের দুপাশ জুড়ে বিক্ষোভের স্লোগান শোনা গেছে রাজতন্ত্রবিরোধীদের কণ্ঠে। নতুন আইন জারি সত্ত্বেও ‘অনড় বিক্ষোভ’ প্রদর্শন চালিয়ে যান তারা! রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান ঘিরে বিক্ষোভে নামা অ্যাকটিভিস্ট গ্রুপ ‘রিপাবলিকের’ প্রধান নির্বাহী গ্রাহাম স্মিথকে বলতে শোনা যায়, ‘রিপাবলিককে দমিয়ে রাখা যাবে না। বিক্ষোভ চালিয়ে যাব আমরা।’ যদিও বিক্ষোভকারীদের প্রতি সহনশীল আচরণ করতে দেখা যায় নিরাপত্তা বাহিনীকে।
রাজ-অভিষেক অনুষ্ঠান সামনে রেখে সবার দৃষ্টি ছিল চার্লসের দ্বিতীয় সন্তান প্রিন্স হ্যারির দিকে। পিতার অভিষেক অনুষ্ঠানে হ্যারি উপস্থিত ছিলেন বটে, তবে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় দেখা যায়নি তাকে। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে প্রকাশ্যে রাজপরিবারে সব ধরনের ভূমিকা পালন থেকে সরে দাঁড়ান হ্যারি। রাজপরিবার সম্পর্কে তার লেখা একটি বই হইচই ফেলে দেয় সারা বিশ্বে। হ্যারির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মনে করেন, ‘রাজাকে মুকুট পরানোর মতো গুরুত্বহীন অনুষ্ঠানের আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই!’
রাজার সিংহাসন আরোহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নামিদামি সব বিশ্বনেতা। বসে তারকাদের মিলনমেলাও। সস্ত্রীক জাপানের ক্রাউন প্রিন্স আকিশিনো থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন স্পেনের রাজা ফিলিপ ষষ্ঠ ও রানি লেটিজিয়া পর্যন্ত। ‘রাজ-অভিষেক অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপস্থিত না থাকার ধারা’ এবারও বজায় রাখে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেনের পদমুখরিত হয়েছে এবারের অনুষ্ঠান। অতিথিদের তালিকায় আরো ছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েনের মতো বিশ্বনেতা। রাশিয়া, বেলারুশ, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলা ও ইরানের নেতারা উপস্থিত না থাকলেও অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আলো ছড়ান উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক নেতা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরব উপস্থিতি দৃষ্টি কেড়েছে অনেকের। আমন্ত্রিত ছিলেন উত্তর কোরিয়া ও নিকারাগুয়ার সিনিয়র কূটনীতিকবৃন্দ। এতে কোনো দ্বিমত নেই, রাজা বা রানির রাজ-অভিষেকের অনুষ্ঠান যুক্তরাজ্যের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ফলে এই অনুষ্ঠান ঘিরে সব সময়ই উত্তেজিত, উচ্ছ্বসিত থাকেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ।
এই রাজ-অভিষেক অনুষ্ঠানকে বিশেষভাবে রঙিন করে তোলেন বিশ্বের স্বনামধন্য শিল্পীমহল। ক্যাটি পেরি, লিওনেল রিচি, টেক দ্যাট, আন্দ্রেয়া বোসেলিসহ খ্যাতনামা শিল্পীদের সম্মিলিত রাজ-অভিষেক কনসার্টে অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ। প্রথম আফ্রিকান হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে উড়ে আসা সোপ্রানো প্রিটি ইয়েন্ডে রাজ-অভিষেকের অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করে আপ্লুত-উচ্ছ্বাসে ভাসান সবাইকে—‘একজন তরুণী হিসেবে, একজন দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে, একজন শিল্পী হিসেবে আজকের দিনটি আমার জীবনের এক অবিশ্বাস্য সময়, যার আনন্দ আমার হৃদয়কে প্লাবিত করেছে।’