‘রক্ত বা ওষুধ প্রয়োজন হলে বলুন’—এই ধরনের প্ল্যাকার্ড হাতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সামনে দাঁড়ানো তরুণদের ছবিটা হয়তো দেখেছেন। প্ল্যাকার্ডগুলো লিখেছেন আরিফ উদ্দিন। চট্টগ্রাম কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। রাতভর আহতদের সেবা দিয়েছেন। কিন্তু ভোর হওয়ার আগেই জেনেছেন তাঁর বাবা আর নেই!
চট্টগ্রাম কলেজের হোস্টেল গেটে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আড্ডা দেন গোটা ত্রিশেক ছাত্র। সেদিন রাত প্রায় সাড়ে ৯টা। অনেকেই টিউশনি থেকে ফিরে আড্ডায় যুক্ত হয়েছেন। হঠাৎ বন্ধুদের একজন বলে উঠলেন ‘সীতাকুণ্ডে আগুন লাগার খবরটি শুনেছিস?’ ফেসবুকে ঢুকতেই তাঁরা বুঝতে পারেন খবর যেটা শুনেছেন, ঘটনা তার চেয়ে গুরুতর।
ততক্ষণে বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসতে থাকে—আগুনের সঙ্গে প্রকট বিস্ফোরণ হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ঠিক করেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ মানুষকে সাহায্য করবেন। কলেজগেট থেকে সীতাকুণ্ড প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। এরই মধ্যে খবর আসে আহতরা সবাই চট্টগ্রাম মেডিক্যালে আসছে। পরে সবাই সিদ্ধান্ত নেন সীতাকুণ্ড নয়, হাসপাতালেই যাবেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। হাসপাতালে পা ফেলার জায়গা নেই। মানুষজনের প্রচণ্ড ছোটাছুটি। কারোর কথা বলার সময় নেই। অথচ বোঝা যাচ্ছে কারোর রক্ত লাগবে, কারোর লাগবে ওষুধ। মাহমুদরা প্রথমে অ্যাম্বুল্যান্স আসার রাস্তাটা ফাঁকা করে দেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের ভিড় এড়িয়ে এক মিনিট আগেও যদি অ্যাম্বুল্যান্স হাসপাতালে ঢুকতে পারে হয়তো আরো একটা জীবন বাঁচবে। ’
এত মানুষের ছোটাছুটি দেখে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আসা ছাত্রদের দলটি বেশ বিচলিত হয়। কার কী লাগবে এটা জনে জনে জিজ্ঞেস করা কঠিন। তখন তাঁরা আশপাশে ফেলে দেওয়া কাগজের কার্টন সংগ্রহ করে সেই কার্টনে লেখেন ‘রক্তের প্রয়োজন হলে জানান’ ‘ওষুধ লাগলে বলুন’, ‘ইনজেকশনের দরকারে যোগাযোগ করুন। ’ সব প্ল্যাকার্ড লেখেন আরিফ। প্ল্যাকার্ড হাতে কয়েকজন বন্ধু দাঁড়ান হাসপাতালের বাইরের গেটে। আর অন্যরা ছুটতে লাগলেন ওষুধ, পানি, রক্ত সংগ্রহের কাজে। এই দলের সদস্য আরিফ নিজেও হাতে তুলে নেন ‘রক্ত লাগলে বলুন’ লেখা প্ল্যাকার্ড। কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্তের প্রয়োজনে ছুটে এলেন অনেকেই। সেই রাতেই প্রায় ২২ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে আরিফরা জমা দেন হাসপাতালে। সঙ্গে অনেক ওষুধ আর পানি। ‘আমরা সবাই ছাত্র। তবু যার কাছে যত টাকা ছিল সব এক জায়গায় করে সেই টাকায় যতটা পেরেছি ওষুধ, পানি আর স্যালাইন কিনে এনেছি। এখানকার ফার্মেসির মালিকরাও সেই রাতে বিনা মূল্যে অনেক ওষুধ দিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যালে যাব শুনলে রিকশাচালকও ভাড়া নেননি। ’ বলেন দলের সদস্য মেশকাত।
আরিফের ছোটাছুটি একটু বেশি। কারণ দলের অন্য সদস্যদের চেয়ে এ ধরনের কাজে আগে থেকেই তিনি উৎসাহী ছিলেন। ওষুধ, রক্ত, পানি পৌঁছে দিতে দিতে রাত ৩টার মতো বেজে যায়। তখনই ফোন করেন মাকে। মা জানে এ রকম বিপদের দিনে ছেলে কোনো দিনও ঘরে থাকে না। তাই তিনি বলেছেন, ‘কাজ শেষ করে সকালে খাবার খেয়ে নিতে। ’ আরিফও মাকে অভয় দিয়ে ঘুমিয়ে যেতে বলে ফোন রাখেন। তবে ঘণ্টাখানেক পর আরিফের মোবাইলে আবার তাঁর মায়ের কল আসে। আরিফ এবার একটু অবাক হন। এতক্ষণে তো মায়ের ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা। তবে কল ধরতেই মায়ের কান্নার শব্দ! পরমুহূর্তে শোনেন তাঁর বাবা আর নেই। আরিফের বাবা মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী। সেখানেই রাত ৪টার দিকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। শুনে মাথা ঘুরে পড়ে যান আরিফ। তাঁকে ধরে ফেলেন তাঁর বন্ধু মেশকাত। রাতভর অনেকের স্বজনদের জন্য রক্ত, ওষুধ নিয়ে ছোটাছুটি করা ছেলেটা সকালে বাড়ি ফিরেছেন নিজের জনক হারানোর শোক নিয়ে।