সুনামগঞ্জের ‘হাওরকন্যা’ টাঙ্গুয়ার হাওর সুখ্যাতি অর্জন করেছে। মিঠাপানির বিশাল এ জলরাশি মৎস্য উৎপাদন, কৃষিতে সেচ, হাওর বিলাসীদের বিনোদন, সর্বোপরি পরিবেশ ও ভূমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষায়, অন্য সব পানির উৎসবের মতো প্রকৃতির এক বিশাল আশীর্বাদ। উদ্ভিদ, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা-সংরক্ষণে টাঙ্গুয়ার হাওরের ভূমিকা অতুলনীয়। টাঙ্গুয়ার হাওর সুন্দরবনের পর দ্বিতীয় ‘রামসার’। কথিত আছে যে, হাওরে একসময় বাঁশের টং বানিয়ে কৃষক ধান পাহারা দিতেন। সম্ভবত সে কারণেই টং থেকে টাঙ্গুয়া নামকরণ হয়েছে। ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জে হিমালয়ের পাদদেশে প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির এ জলাভূমি। হাওরটিকে নয় কুঁড়িকান্দার, ছয় কুঁড়ি বিল নামেও ডাকা হয়। হাওরটির স্বচ্ছজল, সারি সারি খরচ, জারুল, হিজল, নলখাগড়া, সিংড়া, চাইল্যাবন, বৌলা, বনতুলসী, হুকল, সুজ্জারখাটা, ঝিরানি, লাল-সাদা শাপলাসহ ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ হাওরটিকে রূপের রানি করেছে।
টাঙ্গুয়ার হাওরকে মিঠা পানির মাছ উত্পাদনের খনিও বলা হয়। বন্যার সময় দূরদূরান্ত থেকে ভেসে আসা মাছ হাওরে ঢুকলে আর ফিরে যেতে চায় না। হাওরে প্রায় বিলুপ্ত মাছ নানিন, রানি, হিলইনসহ ১৪২ প্রজাতির মাছ, ১৩ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির বিলুপ্ত কচ্ছপ, সাত প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ, ২৬ প্রজাতির বিভিন্ন বন্যপ্রাণী এবং দেশি-বিদেশি পাখির অভয়ারণ্য এ হাওর। ২০১৯ সালের পাখি শুমারিতে, ২০৮ জাতের পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। বিরল প্রজাতির পাখি প্যালাসেস সামুদ্রিক ঈগল, বড় আকারের প্যাকিংস্টক পাখির বাস এ হাওরে। শকুন, পানকৌড়ি, বেসুনিকালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, পাতিহাঁস, টিকিহাঁস, স্কপহাঁস, গাঙচিল, শঙ্খচিল, উদয়ীজিরিয়া, সাদাবক, কাইম, সারস, কাক, চিলসহ নানা জাতের পাখি বাস করে এ হাওরে। বিশ্বে বিপন্ন হলেও বেয়ারের ভূতিহাঁস আটটির মধ্যে পাঁচটিই দেখা যায় টাঙ্গুয়ার হাওরে।
হিমালয়ের উত্তরে মেঘালয়ের মনোমুগ্ধকর পাহাড়ের দর্শনীয় স্থান, টেকেরঘাটের পরিত্যক্ত চুনাপাথর প্রকল্প, নিলাদ্রি বারিক টিলা, জাদুকাটা নদী, শাহ আরফিন (রহ.) মাজার, আশ্রম, ইসকন মন্দির এবং বিলুপ্ত লাউড় রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পর্যটকদের ভিড় জমেই থাকে। রূপের রানি জাদুকাটা নদীর অগভীর চলন্ত প্রবাহমান জল সুইমিং দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। টাঙ্গুয়ার হাওরসহ অসংখ্য হাওর-বিল-ঝিলবেষ্টিত সুনামগঞ্জকে বলা হয় ‘হাওরকন্যা সুনামগঞ্জ’।
সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪১ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায় টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। শ্রীপুর উত্তর, শ্রীপুর দক্ষিণ, বড়দল উত্তর ও বড়দল দক্ষিণ—এ চারটি ইউনিয়ন জুড়ে ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওর মিলে ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর জমি নিয়ে এ টাঙ্গুয়ার হাওর। পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার, বাকি বসতি ও কৃষিজমি। হাওরের পূর্বে ১২০টি কান্দাপারবিশিষ্ট ১৮০টি বিল ছিল। কালের বিবর্তনে ক্রমে এখন ছোট-বড় ১০৯টি বিলের মধ্যে প্রধান ৫৪টি বিল। এসব বিলের ভেতর জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য খাল-নালা একটি অপরটিকে সংযুক্ত করেছে। বর্ষার সময় সব বিল মিলে একাকার হলে শুধু থইথই পানি দেখা যায়। এ হাওরকে অনেকেই বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে তুলনা করেন।
আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত সুন্দরবনের পর দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’ হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওর। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষায় সম্মিলিত প্রয়াসের নামই হলো ‘রামসার’। ১৯৭১ সালে ইরানের ‘রামসার’ নগরে প্রথম বিশ্বের পরিবেশবাদীদের কনভেনশনের ‘অন ওয়েটল্যান্ডস’ নামক একটি সমঝোতা স্মারক করলে ১৫৮টি দেশ স্বাক্ষর করে এবং পৃথিবীর ১৬৯ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা জুড়ে ১ হাজার ৯২৮টি গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমিকে চিহ্নিত করে তালিকাভুক্ত করা হয় এবং পরে টাঙ্গুয়া হাওরও স্থান পায়। আদিকাল থেকে হাওরের মাছ, পশু-পাখি অবাধে শিকার, গাছগাছালি, হাওরের উদ্ভিদ এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছিল। ফলে ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে সংকটাপন্ন ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের মানুষের হৃদপিণ্ড টাঙ্গুয়া হাওরকে ‘রামসার’ ঘোষণা করা হয়। ২০০১ সালের ১২ জানুয়ারি হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর থেকে সরকার সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসনের হাতে হাওরটির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। তখন থেকে দীর্ঘ কয়েক যুগের জোতদারি, জবরদখলবাজি ও লুটপাটের অবসান ঘটে। বর্তমানে এক জন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ২৪ জন আনসার ও স্থানীয় কমিউনিটি গাইডও দায়িত্ব পালন করছেন।
টাঙ্গুয়ার হাওর প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে সোনা ও হীরার চেয়ে অনেক দামি। হাওরপারের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করা না হলে, হাওরের সম্পদ রক্ষা করা খুবই কঠিন। বর্ষা-শরত্কালে হাজার হাজার পর্যটক নৌকাযোগে ভ্রমণ করলেও শুষ্ক মৌসুমে রাস্তার অভাবে পর্যটকরা আসতে পারেন না। সেখানে থাকা-খাওয়ারও কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। টেকেরঘাটে বিলাসবাড়ি নামে কাঠের বাড়ি থাকলেও পর্যটকদের স্থান সংকুলান হয় না।
টাঙ্গুয়ার হাওরপারের ৮৮টি গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বোরো ফসল ও হাওরের মাছ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরা, শিলা বৃষ্টিতে ধান ক্ষতিগ্রস্ত না হলে প্রচুর ধান কৃষকের ঘরে যায়। বিলের সরকারি খাসজমির সঙ্গে কৃষকের পুকুর ও জলাশয় রয়েছে। সেখানে কৃষকরা প্রচুর মাছ ধরে থাকেন। শীতকালে এসব মাছ ইউরোপ ও মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। ঢাকা-সিলেটসহ দেশের অন্যান্য স্থানে মিঠাপানির এ মাছের চাহিদা অনেক বেশি।
বিলের তীরের জমিতে শীতকালে রবিশস্যও উৎপাদন করা হয়। জলাবদ্ধতায় অনেক সময় জমি অনাবাদি থেকে যায়। বর্তমান সময়ে কৃষকরা হাওরে ফসলের চারা রোপণ করছেন। এতে কিছু কিছু অতিথি পাখি হাওরের আকাশে এসে ঘুরে চলে যায়। মাসখানেক পর হাওরের পানি কমলে বা ধানের চারা সবুজ হলে খাদ্যের সন্ধানে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসবে। পাখির কিচিরমিচির ডাক ও কলকাকলিতে হাওর এলাকায় অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পাখিরা দল বেঁধে ফসলেরও ক্ষতি করে। শামুক ভাঙ্গরি নামে এক ধরনের পাখি দুই থেকে তিন ফুট পানিতে প্রচুর শামুক-ঝিনুক ধরে খেয়ে থাকে। শ্রীপুর বাজার থেকে হাওর পর্যন্ত চার কিলোমিটার রাস্তা পাকা না হওয়ায় পর্যটকদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত এবং জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিকতা রক্ষা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বিল-খাল খননসহ হাওরের উন্নয়ন জরুরি।
আমাদের পবিত্র সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে—রাষ্ট্র, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ জীববৈচিত্র্য জলাভূমি, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবেন। এজন্য সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আলোকেই অর্থনৈতিক উন্নতি, অবহেলিত ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং প্রকৃতি রক্ষায় টাঙ্গুয়ার হাওরকে ঢেলে সাজাতে হবে।