বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বলতে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা মুদ্রাবিষয়ক কর্তৃপক্ষের কাছে বৈদেশিক মুদ্রায় গচ্ছিত সম্পদের মজুতকে বোঝায়। একটি দেশের আমদানি ব্যয় মেটানো, বাজেট বাস্তবায়ন, বৃহত প্রকল্পে অর্থের জোগান, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, আর্থিক বিপর্যয় মোকাবিলা, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন রোধ, মুদ্রানীতি শক্তিশালীকরণসহ নানা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, কোনো দেশে তিন মাসের মোট আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থাকলে সেটা মোটামুটি নিরাপদ। আবার দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জমে থাকাও অর্থনীতির জন্য শুভকর নয়। অতিরিক্ত রিজার্ভ অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়া এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের গতি আশানুরূপ না হওয়াকেই ইঙ্গিত করে।
গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা করোনা মহামারি এবং পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়ছে, নিত্যপণ্যের দাম চলে যাচ্ছে হাতের নাগালের বাইরে। হঠাত আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় টান পড়েছে বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। মুদ্রাস্ফীতিতে নাজেহাল সারা বিশ্বের মানুষ। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে গত বছরের আগস্ট মাস নাগাদ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়নের কাছাকাছি ছিল। সেখান থেকে নেমে আসে ৩২ বিলিয়ন ডলারে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমার কারণে এরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে এখন আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বৈশ্বিক সংকটেও রিজার্ভের চাকা সচল হওয়ার বিষয়টি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের অনেক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিম্নগামী, সেখানে বাংলাদেশের রিজার্ভের ঊর্ধ্বগতি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য সুখকর। তবে রিজার্ভ রক্ষায় আরও বেশি সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঋণ পরিশোধ, বিদেশ থেকে পণ্য, কাঁচামাল আমদানিসহ আন্তর্জাতিক প্রায় সব ধরনের লেনদেনে রিজার্ভে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করা হয়। ফলে রিজার্ভের পরিমাণ কমে গেলে আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়। এতে অর্থনীতির গতি কমে যায়। এ ছাড়া রিজার্ভ কমে গেলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধেও বিলম্ব হতে পারে। গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। ১৫ ফেব্রুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, অর্থনীতির বেশ কিছু সূচকে উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে টার্গেট নির্ধারণ করেছে, তাতে জুনে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলার। আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। রপ্তানি আয় বেড়েই চলেছে। রেমিট্যান্সও বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, ধীরে ধীরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। সামনে রোজা ও ঈদ। তিনি মনে করেন, আগামী কয়েক মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়বে। এতে রিজার্ভ আরও স্বস্তিদায়ক অবস্থানে ফিরবে। তবে রাতারাতি পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আর ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে দেশের রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার বা ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে তৈরি এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি এমন পূর্বাভাস দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে ৩ হাজার ২৪৫ কোটি ডলার বা প্রতি মাসে গড়ে ৪৬৪ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি। নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে প্রতি মাসে গড়ে ৫২০ কোটি ডলার রপ্তানি হয়েছে। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয় বেড়ে ১৯৬ কোটি ডলারে ঠেকেছে। আগের মাস ডিসেম্বরে যা ১৭০ কোটি ডলারের নিচে ছিল। আগের তিন মাস নভেম্বর, অক্টোবর ও সেপ্টেম্বরে এসেছিল যথাক্রমে ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ, ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ এবং ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম ১০ দিনে ৬৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে।
এদিকে আমদানি কমাতে শত ভাগ পর্যন্ত এলসি মার্জিন, তদারকি জোরদারসহ বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে আমদানি ব্যয় ২ দশমিক ১৫ শতাংশ কমে ৩ হাজার ৮১৩ কোটি ডলারে নেমেছে। সার্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। এছাড়া আগামী মাসগুলোতে মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে এটাও প্রভাব ফেলবে, বলছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক রাখতে প্রায় প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। রেমিট্যান্সের প্রধান শত্রু হুন্ডি চক্রকে নিয়ন্ত্রণে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে ডলারের সরবরাহ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থাত জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ১ হাজার ৪৯ কোটি ৩২ লাখ (১০.৪৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ২০২১-২২ অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। পোশাক কারখানার মালিকরা বলছেন, আগে কারখানায় ইউরোপ-আমেরিকান বায়ারদের পণ্য তৈরি হতো। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট শুরু পর অর্ডার কমে যায়। তবে ২০২২ সালে ভারত-জাপান কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি করে ভালো আয় পাচ্ছেন তারা। এদিকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সর্বশেষ যে পূর্বাভাস দিয়েছে, সেখানেও ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ভালো অর্থনীতির দেশের তালিকায় সবার ওপরে রেখেছে বাংলাদেশকে।
করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে সারা বিশ্বে কঠিন পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে, যা মোকাবিলায় দেশে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার হিমশিম খাচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারিতে মোকাবিলায় সারা দুনিয়া যেখানে হিমশিম খেয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতীতে যেভাবে করোনা মহামারিসহ নানা সংকট মোকাবিলায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হয়েছেন, তেমনিভাবে রিজার্ভ-সংকট, মুদ্রাস্ফীতি ও বিশ্বমন্দা মোকাবিলায়ও তিনি সফল হবেন।
Thank you very much for uploading class useful and quality content. Good luck material for you with likes and full races
dollar Buy Sell bd