রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার-সংকটের কারণে গত তিন/চার মাস ধরে পুরোনো জাহাজ আমদানি হচ্ছে না। সীতাকুণ্ডের পুরোনো জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডগুলো প্রায় খালি পড়ে রয়েছে। মাত্র ছয়/সাতটি ইয়ার্ডে জাহাজ ভাঙার কাজ চলছে। এ অবস্থায় দেশের রি-রোলিং মিলগুলো কাঁচামাল-সংকটে পড়েছে। স্ক্র্যাপ-সংকটে বিলেট তৈরি করা যাচ্ছে না। এতে রড তৈরির কাঁচামাল ও রডের দাম ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে রডের উৎপাদন খরচ। সংশ্লিষ্টরা জানান, জাহাজ আমদানি বন্ধ থাকলে সামনে রি-রোলিং মিলগুলো চরম কাঁচামাল-সংকটে পড়বে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৬০টি জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ড রয়েছে। ইয়ার্ডগুলোতে পুরনো জাহাজ ভাঙা হয়। এসব কাজে হাজারো শ্রমিক জড়িত রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পুরোনো জাহাজ আমদানি হয়ে থাকে। গত কয়েক মাস ধরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে ডলার-সংকটে অন্যান্য আমদানি পণ্যের মতো পুরোনো জাহাজ আমদানিতেও স্থবিরতা বিরাজ করছে। এলসি খোলা কঠিন হয়ে পড়ায় জাহাজ আমদানি হচ্ছে না।
জানা যায়, বর্তমানে ছয়/সাতটি ইয়ার্ডে পুরোনো জাহাজ ভাঙার কাজ চলছে। এতে ৪-৫ লাখ টনের বেশি স্ক্র্যাপ হবে না। অথচ স্বাভাবিক অবস্থায় ইয়ার্ডগুলোতে ১৭/১৮ লাখ টন স্ক্র্যাপ থাকত। যেসব জাহাজ ভাঙার কাজ চলছে সেগুলো আগে আমদানি করা। বাকি ইয়ার্ডগুলোতে স্থবিরতা বিরাজ করছে। ইয়ার্ডে কাজ নেই। শ্রমিকরা বেকার সময় কাটাচ্ছে।
দেশে দুই ধরনের রি-রোলিং মিল রয়েছে। এসব মিলে ৪০ ও ৬০ গ্রেডের রড তৈরি করা হয়। বর্তমানে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ৬০ গ্রেডের রি-রোলিং মিল চালু হয়েছে। ৪০ গ্রেডের মিল অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। ৪০ গ্রেডের রডের চাহিদা বাজারে কম। ফলে প্রতিযোগিতায় ছোট মিলগুলো টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রড তৈরিতে স্ক্র্যাপ দিয়ে বিলেট তৈরি করে ব্যবহার করা হয়। আবার অনেকেই বিলেট সরাসরি বিদেশ থেকে আমদানি করে। তবে বিলেট আমদানি গত কয়েক বছর ধরে কমে গেছে। বড় রি-রোলিং মিলগুলো নিজেদের তৈরি কারখানায় স্ক্র্যাপ নিয়ে বিলেট তৈরি করে রড তৈরিতে ব্যবহার করছে। ফলে জাহাজ আমদানি কমে যাওয়ায় রি-রোলিং মিলগুলো স্ক্র্যাপ-সংকটে পড়েছে।
বিএসআরএমের জেনারেল ম্যানেজার তপন সেনগুপ্ত বলেন, জাহাজ আমদানি কমে যাওয়ায় রি-রোলিং মিল কাঁচামাল-সংকটে পড়েছে। আমাদের নিজস্ব কারখানায় বিলেট তৈরি করা হয়। কিন্তু স্ক্র্যাপ-সংকটে বিলেট তৈরি ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৬ হাজার টন স্ক্র্যাপের চাহিদা থাকে। স্ক্র্যাপ-সংকট অব্যাহত থাকলে সামনে অধিকাংশ রি-রোলিং মিল বন্ধ হয়ে যাবে। গত কয়েক বছর ধরে বিলেট আমদানি কমে গেছে। দেশেই বিলেট তৈরি করা হচ্ছে।’
রোলিং মিল মালিক নাজির আহমেদ সিকদার বলেন, স্ক্র্যাপ পাচ্ছি না। আমার রোলিং মিল বন্ধ রেখেছি। বাজারে যেভাবে স্ক্র্যাপের দাম বেড়েছে মিল চালানো যাচ্ছে না। আমার মতো অনেকেই মিল বন্ধ করে দিয়েছে।
পুরোনো জাহাজ ভাঙার স্ক্র্যাপ ব্যবসার সঙ্গে কয়েক শ লোক জড়িত রয়েছে। জানতে চাইলে স্ক্র্যাপ বায়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাক জান্নাতুল ইসলাম বলেন, জাহাজ আমদানি না হওয়ায় তিন/চার জন ইয়ার্ডমালিকের কাছে স্ক্র্যাপ ও প্লেইট রয়েছে। তারা এখন চড়া দামে এসব স্ক্র্যাপ বিক্রি করছে। ৮০ শতাংশ রি-রোলিং মিল বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা ইয়ার্ড থেকে স্ক্র্যাপ সরবরাহ পাচ্ছি না।
জানা যায়, বর্তমানে দাম বেড়ে জাহাজ ভাঙার স্ক্র্যাপ প্রতি টন ৫৮ থেকে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ এসব স্ক্র্যাপ প্রতি টন টন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার বেশি বিক্রি হয়নি। আর দাম বেড়ে প্লেইট বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ৭৫ হাজার টাকায়। রি-রোলিং মিলে কাঁচামালের সংকটে রড তৈরিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বাজারে চাহিদা অনুপাতে রড সরবরাহ পাচ্ছে না বিক্রেতারা। এখন বাজারে ৬০ গ্রেডের রড প্রতি টন প্রায় ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রডের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে নির্মাণশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে রডের দাম। অনেকেই নির্মাণকাজ অর্ধেক করে ফেলে রেখেছে।