যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে মেট্রোরেল ব্যবস্থার যুগে বাংলাদেশ প্রবেশ করতে যাচ্ছে ২৮ ডিসেম্বর। ঐ দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর গণপরিবহনের এই নতুন দিগন্তের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।
মেট্রোরেলে ১৬টি স্টেশন থাকবে। অর্থাৎ দুটি স্টেশনের মধ্যে গড় দূরত্ব হবে ১ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার। বেশি স্টেশন রাখার ফলে বিপুলসংখ্যক যাত্রী এর সুফল ভোগ করবে। ওপরে এবং নিচ থেকে লিফট বা চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে যাত্রীদের ওপরে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। মেট্রোরেল পূর্ণ সক্ষমতায় ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। এর গতি হবে গড়ে ঘণ্টায় ৩২ কিলোমিটার, যদিও এটি সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার চলতে সক্ষম। পিক আওয়ারে ৪ মিনিট পরপর একটি ট্রেন এবং অফ-পিক আওয়ারে ৭ মিনিট পরপর একটি ট্রেন চলবে। শীতকালে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ও গ্রীষ্মকালে সকাল ৫টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ট্রেন চলবে। মেট্রোরেল পুরোটাই হবে উড়ালপথে। বিদ্যমান সড়কের মাঝখানে আড়াই মিটার জায়গা নেওয়া হবে। উচ্চতা হবে মাটি থেকে ৮-১৩ মিটার পর্যন্ত।
ইতিমধ্যে বহুল কাঙ্ক্ষিত মেট্রোরেলে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কিলোমিটার ৫ টাকা আর সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা।
২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সরকার মেট্রোরেল প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। তখন মেয়াদকাল ছিল ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। ২০১৬ সালের ২৬ জুন নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্মাণকাজের উদ্বোধনের প্রায় সাড়ে ছয় বছর পর মেট্রোরেলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেল চলাচলে প্রচণ্ড শব্দ ও তীব্র কম্পনের ফলে শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে বলে মানববন্ধন করেছে। বুয়েটের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, মেট্রোরেল চলাচলে আশপাশে তীব্র কম্পনের সৃষ্টি হবে প্রশ্ন উঠেছে।
তিনি বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পটিতে কম্পন নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। মেট্রোরেলের লাইনের নিচে এমএসএস (ম্যাস স্প্রিং সিস্টেম) থাকবে। ম্যাস স্প্রিং সিস্টেমে বিশেষ ধরনের বিয়ারিং থাকে, যার কাজ হলো রেললাইনে যে কম্পন তৈরি হয় তা শোষণ করা। এর ফলে ট্রেন চলাচলের সময় আশপাশে তেমন একটা কম্পন অনুভূত হবে না।
মেট্রোরেল প্রকল্পটিতে বিদ্যুৎচালিত আধুনিক ট্রেনে যাত্রীরা চলাচল করবে। ভিভিভিএফ (ভেরিয়েবল ভোল্টেজ ভেরিয়েবল ফ্রিকোয়েন্সি) ইনভার্টার সিস্টেমে চালিত ট্রেন চলার সময় অনেক কম শব্দ তৈরি করে, যা শব্দদূষণের পর্যায়ে পড়ে না। মেট্রোরেল প্রকল্পটি চালু হলে ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাস ব্যবহারকারী অনেক যাত্রী মেট্রোরেলে যাতায়াত করবে। এর ফলে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসারণের পরিমাণ অনেক কমবে। অন্যদিকে মেট্রোরেল যেহেতু বিদ্যুত্চালিত তাই বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসারণের পরিমাণ নেই বললেই চলে। এসব বিবেচনায় মেট্রোরেল পরিবহন ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব।
রাজধানী ঢাকার যানজট সমস্যা এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে, গণপরিবহন হিসেবে সাধারণ বাস দিয়ে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় যানজট সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে বড় বিকল্প হচ্ছে মেট্রোরেল। বিশ্বের সর্বাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যবস্থা এই মেট্রোরেল প্রকল্প রাজধানীর যানজট সমস্যা নিরসনের পাশাপাশি যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বয়ে আনবে।
মেট্রোরেলের চালকের পদটির নাম ‘ট্রেন অপারেটর’। এই পদে ২৫ জনের সঙ্গে নিয়োগ পেয়েছেন মরিয়ম আফিজা। স্টেশন থেকে ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় করবেন স্টেশন কন্ট্রোলার। এই পদে ৩৪ জনের সঙ্গে নিয়োগ পেয়েছেন আসমা আক্তার। ট্রেন অপারেটর কখনো কখনো স্টেশন কন্ট্রোলারের দায়িত্ব পালন করবেন। আবার স্টেশন কন্ট্রোলার প্রয়োজন হলে ট্রেন চালাবেন। মরিয়ম ও আসমা ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের হালিশহরে বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেনিং একাডেমিতে দুই মাসের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ঢাকায় ফিরে আরও চার মাস প্রশিক্ষণ নেন। প্রয়োজনে ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিদের জাপানেও প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে কর্তৃপক্ষের। মরিয়ম আফিজা, মেট্রোরেল অপারেটর পদে নিয়োগ পাওয়া নারী। মরিয়ম আফিজা নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। তিনি বলেন, মেট্রোরেল বাংলাদেশে প্রথম। এই চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন আগ্রহ থেকেই।
আসমা আক্তার, মেট্রোরেলের স্টেশন অপারেটর পদে নিয়োগ পাওয়া নারী। আসমা আক্তার রাজধানীর তিতুমীর কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক করেন। স্টেশন কন্ট্রোলার পদে নিয়োগ পেয়েছেন ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট। তিনি বলেন, ‘পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে একটা চাকরি করব, শুধু এটা ভেবেই এখানে আসিনি। মেট্রোরেল ব্যবস্থার প্রতি একটা প্যাশনও কাজ করেছে। এ জন্য প্রশিক্ষণে মেট্রোরেলের খুঁটিনাটি সবই রপ্ত করার চেষ্টা করছি।’ তিনি বলেন, ‘আমার পদ স্টেশন কন্ট্রোলার হলেও ট্রেন চালাতে হতে পারে। এটা আসলেই একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার।’
যানজটের নগরী ঢাকায় কোনোভাবেই যখন যানজট নিরসন করা যাচ্ছে না, তখন স্বপ্নের মেট্রোরেল এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন।