মানুষের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি বা দৃষ্টিসূক্ষ্মতা হলো ২০/২০। অর্থাৎ, এ ধরনের দৃষ্টির সংজ্ঞা হচ্ছে ২০ ফুট দূর থেকে একটি বস্তুকে স্পষ্টভাবে দেখার ক্ষমতা। দৃষ্টির এই স্বচ্ছতা এনে দেয় মূলত চোখের রেটিনা। রেটিনা হলো স্নায়ুকোষযুক্ত চোখের একটি পাতলা স্তর, যা আলোকসংবেদী কোষ ফটোরিসেপ্টর (রড ও কোণ কোষ), বাইপোলার কোষ ও গ্যাংলিওন কোষ এবং সঙ্গে দুটি দৃষ্টি-সমন্বয়কারী কোষ হোরাইজোন্টাল ও অ্যামাক্রিন কোষ, নিয়ে গঠিত। সমন্বিতভাবে এই কোষগুলো রেটিনায় একটি জটিল সার্কিট তৈরি করে, যা দৃষ্টিগত উদ্দীপনাকে তড়িৎ-রাসায়নিক শক্তি বা স্নায়বিক প্রতিক্রিয়ায় রূপান্তরিত করে। রড কোষগুলো আবছা বা মৃদু আলোতে দেখতে সাহায্য করে (নিরালোক দৃষ্টিশক্তি), আর কোণ কোষগুলো স্বাভাবিক উজ্জ্বল আলোতে দেখতে সাহায্য করে (সালোক দৃষ্টিশক্তি)। রেটিনা ও অপটিক স্নায়ু হলো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের অংশ। মানবচক্ষুতে রয়েছে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ রড কোষ ও মাত্র ৬০ লাখ কোণ কোষ। রেটিনার কোণ-ফটোরিসেপ্টরগুলো তিনটি ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর প্রতি সংবেদনশীল অপসিন প্রোটিন নিয়ে গঠিত, যা দিনের উজ্জ্বল আলোয় বিভিন্ন রঙের দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণে ব্যবহৃত হয়। রেটিনার পশ্চাদ্ভাগে (রেটিনা এবং কোরয়েড স্তরের মাঝে) ‘রেটিনা পিগমেন্ট এপিথেলিয়াম’ নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ এপিথেলীয় কোষস্তর রয়েছে, যা রেটিনাকে সজীব রাখতে এবং আলো শনাক্ত করতে ফটোরিসেপ্টর কোষগুলোকে সক্ষম করে তোলে।
ম্যাকুলার গুরুত্ব ও অবক্ষয় : রেটিনার কেন্দ্রে রয়েছে একটি ডিম্বাকৃতির হলুদ রঙের এলাকা যা ‘ম্যাকুলা’ নামে পরিচিত। মানুষের রেটিনাতে কোণ কোষগুলোর অধিকাংশই রেটিনার কেন্দ্রীয় বা ম্যাকুলা অঞ্চলে ঘনীভূত। ম্যাকুলার ব্যাস প্রায় ৫.৫ মিমি (০.২২ ইঞ্চি)। ম্যাকুলার মাঝে রয়েছে ফোভিয়া (fovea)। বইপড়া, গাড়ি চালনা ইত্যাদি যেসব কাজে তীক্ষদৃষ্টির প্রয়োজন, সেসব কাজে ফোভিয়া ব্যবহৃত হয়। ম্যাকুলা ক্ষতিগ্রস্ত বা ক্ষয়প্রাপ্ত হলে ম্যাকুলা-সম্পর্কিত দৃষ্টি-প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। যেসব চোখের রোগে মানুষ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে সেগুলো হলো বয়সজনিত ম্যাকুলার ডিজেনেরেশন, গ্লুকোমা, ক্যাটারাক্ট ও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। এছাড়া, আঘাতজনিত কারণ ও ভিটামিনের অভাবেও অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে। এই প্রবন্ধে শুধু ম্যাকুলার ডিজেনেরেশন ও তার সম্ভাবনাময় চিকিৎসা নিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
বয়স-সম্পর্কিত ম্যাকুলার ডিজেনেরেশন (এএমডি) : এটা হচ্ছে ম্যাকুলার অবক্ষয় বা ভাঙন, যার ফলে চোখের কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে থাকে, এমনকি পুরোপুরি দৃষ্টিহীন হওয়ায় সম্ভাবনাও রয়েছে। যদিও ম্যাকুলার অবক্ষয়ের কারণে পেরিফেরাল বা পার্শ্বীয় দৃষ্টি সাধারণত প্রভাবিত হয় না, তবে বিস্তারিত দেখার জন্য প্রয়োজনীয় তীক্ষ, কেন্দ্রীয়দৃষ্টি বা সোজা-সামনের দৃষ্টি হারায়। প্রথমদিকে এএমডি রোগের প্রায়ই কোনো উপসর্গ থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ খারাপ হতে থাকে যা উভয় চোখকে প্রভাবিত করতে পারে। কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তি হারানোর ফলে মানুষকে চিনতে, গাড়ি চালাতে, পড়া বা দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ সমপাদন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ম্যাকুলার ডিজেনেরেশন বা অবক্ষয় সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়, যদিও শিশু এবং অল্প বয়স্কদের মধ্যেও ম্যাকুলার অবক্ষয়জনিত এএমডি-সমতুল্য স্টারগার্ড রোগ দেখা দিতে পারে, যা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একক-জিনগত রেটিনার একটি রোগ।
বয়সজনিত ম্যাকুলার অবক্ষয় (এএমডি) হতে পারে ‘শুষ্ক’ বা ‘ভেজা’। এএমডি-র শুষ্ক রূপটিতে RPE ও ফটোরিসেপ্টরগুলো ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং ম্যাকুলা পাতলা হয়ে যায়। এই রূপের উল্লেখযোগ্য কোনো চিকিৎসা নেই। তবে পুষ্টিকর সম্পূরক, যেমন ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, লুটেইন, জিজ্যান্থিন, জিঙ্ক এবং ক্যুপ্রিক অক্সাইড এই রোগের অগ্রগতি ধীর করে দিতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে, শুষ্ক-এএমডি রোগীদের চোখে টেলিস্কোপিক লেন্স প্রতিস্থাপন করে দৃষ্টিশক্তি উন্নত করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, এএমডি-র ‘ভেজা’ আকারে, রেটিনার নিচে একটি
অস্বাভাবিক রক্তনালির স্তর বৃদ্ধি পায় এবং অনিয়ন্ত্রিত ঐ রক্তনালিগুলোয় যত্রতত্র ফুটো হয়ে তরল পদার্থ ও রক্ত নির্গত হতে পারে। ফলে, কেন্দ্রীয় দৃষ্টি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে। ‘ভেজা এএমডি’ রোগটিকে অ্যান্টি-ভেজেফ থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। ২০২০ সালের হিসাবে, এএমডি বিশ্বব্যাপী ১৯ কোটির বেশি লোককে প্রভাবিত করেছে এবং অনুমান করা হচ্ছে যে ২০৪০ সাল নাগাদ এর প্রকোপ সাড়ে ২৪ কোটিতে উন্নীত হবে। এটি পুরুষ এবং নারীদের মধ্যে সমানভাবে দেখা যায়।
এএমডি রোগের কারণসমূহ : এএমডি হলো ম্যাকুলার অবক্ষয় এবং এটি বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি রোগ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। এএমডি রোগের প্রাথমিক কারণ হলো চোখের রেটিনাল পিগমেন্ট এপিথেলিয়াম-এর অবক্ষয়, যার ফলে এএমডি রোগীদের ক্ষেত্রে ফটোরিসেপ্টর (রড/কোণ) কোষগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয় (অ্যাট্রোফি), ফলে অপরিবর্তনীয় দৃষ্টিহীনতা সৃষ্টি করতে পারে। এএমডি রোগটিকে অনেকে চোখের আলঝেইমার্স বলে আখ্যায়িত করেছেন। এএমডি রোগের ঝুঁকিপূর্ণ প্রধান কারণগুলো হলো বয়স, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, উচ্চ মাত্রার সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন (ঈজচ), স্থূলতা, হৃদরোগ, হালকা রঙের চোখ (নীল বা সবুজ আইরিস), ধূমপান, সূর্যালোক থেকে প্রাপ্ত অতিবেগুনি রশ্মি এবং পারিবারিক ইতিহাস বা জেনেটিক্স। শেষোক্ত কারণটি মূলত জিনগত এবং সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে এএমডি হওয়ার প্রবণতা সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় তিন থেকে ছয় গুণ বেশি।